মিনহাজ বিন মাহবুব
মুক্তমত
ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতন হোন
এক যুগ আগেও দেশে ক্যানসার রোগী ছিল খুবই অল্প। গ্রামীণ জনপদের লোকরা ক্যানসার রোগের নামও জানত না। কয়েকজন নাম জানলেও ক্যানসারের ভয়াবহতা কিংবা পরিণাম সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা কারোরই ছিল না বললেই চলে। এর কারণ হলো আশপাশে কয়েক গ্রাম মিলে কয়েক বছরেও কোনো ক্যানসার রোগীর খবর পাওয়া যেত না। গ্রামের মানুষের ধারণা ছিল, এটি শহরের একটি রোগ এবং এটি শুধু বিত্তশালী লোকদের হয়ে থাকে। তবে, সময়ের সঙ্গে বদলেছে দৃশ্য। এখন আর ক্যানসার বিত্তশালীদের রোগ নয়, গ্রামীণ জনপদের দরিদ্র মানুষদেরও ছাড়ছে না এই মরণব্যাধি। গ্রাম কিংবা শহর সবখানে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য মতে, ২০১২ সালেও হাসপাতালটি বহির্বিভাগে রোগী ছিল বছরে ৫৯ হাজার। তবে দেশে বর্তমানে ১৫ লাখেরও বেশিসংখ্যক ক্যানসার আক্রান্ত রোগী রয়েছে, বলছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্যানসার সোসাইটি। এর মধ্যে করোনাকালে অর্থাৎ ২০২০ সালে শনাক্ত হয়েছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭৭৫ জন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছিল ৯ হাজারেরও বেশি।
পরিবেশ দূষণ, খাদ্যে ভেজাল এং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনেরের কারণে বাড়ছে নানা রোগ। ফলে নানা রোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা ধরনের ক্যানসার। এ রোগ বৃদ্ধির মূল কারণগুলো হলো- পরোক্ষ ধূমপান ও প্রত্যক্ষ ধূমপান, তামাক সেবন, পরিবেশ দূষণ, খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি, শাকসবজি ও ফলমূলে কীটনাশক প্রয়োগ, প্রিজার্বড ফুড খাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্যানসারসহ নানা রকম রোগ সৃষ্টির উপাদানগুলো বন্ধের না আছে সরকারি কোনো জোরালো ভূমিকা, না আছে নাগরিক সচেতনতা। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশক পর ক্যানসার মহামারি আকার ধারণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণ।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন ১৫ লাখের মতো ক্যানসার রোগী। প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে আরো প্রায় তিন লাখ। তাদের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার আওতায় আসে অল্পসংখ্যক রোগী। বাকিরা চিকিৎসার বাইরে থেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
দেশে ক্যানসার রোগীরা যে কটি সমস্যায় পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম একটিা হলো রোগ নির্ণয় করা। বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগ নির্ণয় করতেই কয়েক বছর লেগে যায়। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, কয়েক বছর সঠিক রোগের কোনো ওষুধ-ই পায় না। এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল দৌড় আর হাজার রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কয়েক লাখ টাকা চলে যায়। অধিকাংশ রোগী ক্যানসার হয়েছে এটি জানতে পারে রোগের শেষ ধাপে, এ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় করা গেলেও বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে।
তবে সব থেকে পিছিয়ে আছে নারীরা। রোগের প্রভাব তীব্র না হলে কাউকে বলতে চান না। পরে বললেও পরিবারের কর্তা অনেক সময় গুরুত্ব দেন না। অনেক নারী চিকিৎসার ব্যয় বেশি হওয়ায় মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে মাঝপথেই চিকিৎসা ছেড়ে দেন। আর গ্রামের লোকরা অনেকে রোগের শুরু থেকে পল্লী চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে নিতে রোগের শেষ ধাপে নিয়ে যান। রাষ্ট্রের এই জায়গায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মেডিকেল সায়েন্সে যেখানে প্রযুক্তির এত উন্নতি, সেখানে এখনো আমরা পিছিয়ে। ডায়াগনোসিস করতে পারছি না। এ ব্যাপারে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে, দরিদ্র নারীদের জন্য চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে হবে। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে অন্তত উপজেলা পর্যায়ে ক্যানসারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার সুযোগ সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
ক্যানসারের দ্রুত প্রসার রুখতে হলে প্রয়োজন প্রতিরোধ। খাদ্যে ভেজাল রোধে নিতে হতে হবে কঠোর পদক্ষেপ এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে হতে হবে আন্তরিক। ভেজালকারীদের বিচার দ্রুততর করা ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। কৃষকরা শাকসবজি ও ফলমূলে যাতে ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশক বা ফরমালিন মেশাতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। বাজারগুলোতে নিয়মিত এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। মাছ, মাংস, দুধেও ক্ষতিকর রাসায়নিক বা বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। পশুপাখির ও মাছের খাদ্যেও যেন কোনো ক্ষতিকারক পদার্থ না মিশে, সে ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে। তাই এগুলোও পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা এখন সারা বিশ্বেই একটি অন্যতম শহর। এটিও ফুসফুসের ক্যানসার বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ। সেই সঙ্গে আছে পানিদূষণ ও মাটিদূষণ। এগুলো কমাতে হবে। এ ছাড়া খাদ্যাভ্যাস ও সঠিক জীবনযাপন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তাই নিজে সতর্ক হোন এবং অন্যকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করুন।
লেখক : প্রবাসী ও কলাম লেখক (দোহা, কাতার)
"