শাহ্জাহান কিবরিয়া

  ০৭ মে, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

সিঁদুরে মেঘে অশনিসংকেত

মানবিক শিক্ষার অভাবে আমাদের দেশের কিছু চিকিৎসক ও প্রকৌশলী ধর্মান্ধতার কারণে অমানবিক আচরণ করে থাকেন। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তারা অন্তরে ধারণ করতে ব্যর্থ হন। শৈশবে রচনা লিখতে গিয়ে সব শিক্ষার্থী লিখে থাকে, ‘বড় হয়ে চিকিৎসক হয়ে আমি মানুষের সেবা করব, তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করব।’ অনুরূপভাবে যারা প্রকৌশলী হতে চায়, তারাও তাদের রচনায় দেশের সমৃদ্ধিতে তাদের অবদান রাখার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। কিন্তু দেখা গেছে, ‘কেউ কথা রাখে না।’ শৈশবের কথা সবাই ভুলে যায়। এ দুই পেশার শিক্ষার্থীরা মেধাবী হলেও সাধারণত তাদের অধিকাংশ ধর্মান্ধ হয়ে থাকে। কর্মজীবনে তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ উপার্জনের অভিযোগ পাওয়া যায়। দু-একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তা দিয়ে সবাইকে মূল্যায়ন করা যায় না। চিকিৎসা ও প্রকৌশল শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষার অভাব থাকাও এর একটি কারণ।

বিজ্ঞান মানুষকে যে শিক্ষা দেয়, তা খণ্ডিত শিক্ষা। মানবজীবনের জন্য তা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা নয়। সেটা বিশেষ বিষয়ে পারদর্শিতা হওয়ার শিক্ষা। অন্য বিষয়গুলো অবহেলিত থেকে যায়। বিজ্ঞান মানুষকে সভ্যতায় অবদান রাখে, কিন্তু মানবিক শিক্ষা মানুষকে মানবিক করেছে। বিজ্ঞান মানুষের বাহ্যিক অগ্রযাত্রার সহায়ক শক্তি। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় মানুষকে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষায় শিক্ষিত করে। তার মধ্যে ধর্মশিক্ষাও থাকে। কিন্তু ধর্মশিক্ষা শিক্ষার্থীকে তার বোধগম্যতার অক্ষমতার কারণে অনেক সময় ধর্মান্ধ করে। ধর্মান্ধতার জন্য ধর্ম কখনো দায়ী নয়। একটি ধারালো ছুরিকে ফল কাটার জন্য যেমন ব্যবহার করা যায় কিংবা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসক রোগীকে নতুন জীবন দান করে, তেমনি তা দিয়ে মানুষ হত্যাও করা যায়। দুটির ভালোমন্দ নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। ধর্ম ছুরির মতোই। ধর্ম যেমন মানুষকে মহৎ করে, ধর্মান্ধরা তেমনি মানুষকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যায়।

মানবিক শিক্ষার প্রধান একটি উৎস সাহিত্য। সাহিত্যে সমগ্র মানবজীবন প্রতিফলিত হয়। এতে মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা থাকে, মানুষের সুখ-দুঃখের কথা থাকে, স্নেহ-ভালোবাসার কথা থাকে। সর্বোপরি বিচিত্র মানবিক সমস্যার কথা থাকে। তা পাঠকের হৃদয়ে আবেদন সৃষ্টি করে। মানুষকে মানুষ ভাবতে শেখায়। যে শিক্ষার সঙ্গে হৃদয়ের শিক্ষা থাকে না, সেটা কোনো শিক্ষা নয়। শুধু পেশার উন্নতির জন্য যে শিক্ষা, তা মানুষকে ব্যবসায়ীদের মতো লোভী করে। লোভের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। এ জন্য বিশেষ কোনো ব্যবসায়ীকে দায়ী করা যায় না। সে তখন একটা চক্রের শিকার হয়, যা থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে বিশেষ কষ্টসাধ্য।

আমাদের প্রয়োজন মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত চিকিৎসক ও প্রকৌশলী। ধর্মান্ধ চিকিৎসক ও ধর্মান্ধ প্রকৌশলী আমাদের দরকার নেই। ধর্মান্ধতার কারণে দুই পেশার শিক্ষার্থীরা দেশ ও জাতির উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি করে বেশি। তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অন্য পেশার লোকরাও অপরাধ করে থাকে। কিন্তু ওদের মতো মেধাবী না হওয়ার কারণে মানুষ তাদের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী হয় না। ভালো ফলের গাছ থেকে ভালো ফল আশা করা হয়। তেঁতুলগাছে আপেল ধরে না। ধর্মান্ধ শিক্ষার্থীদের অপ-আচরণের কারণে দেশবাসী হতাশ হয়।

একসময় আমাদের দেশের প্রবীণরা ছোট ছেলেমেয়েদের আশীর্বাদ করতেন- ‘জজ-ব্যারিস্টার হও।’ বর্তমানে আশীর্বাদের ভাষা বদলে গেছে। এখন বলা হয়, ‘ডাক্তার কিংবা প্রকৌশলী হও।’ এ দুই পেশার সম্মানের চেয়ে আর্থিক উন্নতি বেশি হয়। এখনকার মানুষ সম্মানের চেয়ে বিত্তের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে, যার প্রতিফলন ঘটেছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের যোগ্যতার ক্ষেত্রে। সংসদ সদস্যদের অপর নাম ‘আইনপ্রণেতা’। আইনপ্রণয়নে জ্ঞানের চেয়ে তাদের মধ্যবিত্তের জোর বেশি দেখা যায়। এ কারণে দেশের দুরবস্থার অবসান ঘটে না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন চিকিৎসক-প্রকৌশলীকে জানি, যাদের মধ্যে পাঠাভ্যাসের অভ্যাস আছে, তারা আচরণে মানবিক হন। তারা মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম দ্বারা প্রভাবিত। এর ব্যতিক্রমও আছে। আমার পরিচিত এক চিকিৎসককে এক দিন আমার লেখা একটি বই উপহার দিতে গেলে তিনি বলেন, ‘সারাক্ষণ রোগী দেখে ব্যস্ত থাকি। বই পড়ার সময় কোথায়? এক দিন চেম্বারে না গেলে অনেক টাকা ক্ষতি হয়।’

বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামে অনেক উন্নতমানের সাহিত্য রচনা করে সাহিত্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাকে দেশবাসী চিকিৎসকের চেয়ে সাহিত্যিক হিসেবে বেশি চেনে। সুতরাং চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলীরা যে সাহিত্য পড়েন না- এ কথা সর্বাংশে সত্য নয়। যারা মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী, তারা সাহিত্য পাঠ করে থাকে।

বুয়েটে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সংঘাত বা সংকট চলছে, তার পেছনের কারণ খুঁজতে হবে। ধর্মান্ধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাধারণত ধর্মভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখা যায়। এটা প্রমাণিত যে, যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে, তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের ঘাটতি থাকে। এ কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো, এমনকি ইসলামি ছাত্রশক্তি দলও স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। তিনিও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সহযোগী হয়ে দেশে ব্যাপক গণহত্যা ও নারী ধর্ষণে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম আমাদের মা-বোনদের ‘গনিমতের মাল’ বলে ধর্ষণের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছিলেন। তারাও বুয়েটের ধর্মান্ধ শিক্ষার্থীদের মতো মেধাবী ছিলেন। মেধাকে তারা ছুরির মতো মানুষ হত্যায় ব্যবহার করেছিলেন। সেটা যে সব সময় মানবকল্যাণে ব্যবহৃত না হয়ে মানববিধ্বংসী কাজেও ব্যবহৃত হয়, তা তাদের আচরণ দিয়ে তারা প্রমাণ করে গেছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যায়ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশক্তির সদস্যরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। ছাত্র পরিচয় দিয়ে তারা নিজ শিক্ষকদের জবাই করতে দ্বিধা করেনি। যে ধর্ম শিক্ষক হত্যায় ছাত্রকে উৎসাহিত করে, সেটা ধর্ম নয়। অথচ তার জন্য শিক্ষার্থীরা তাদের শক্তির অপচয় করছে। তারা এখনো দেশ-বিদেশে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।

অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে দেশবাসী বুঝতে পেরেছে, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো অকল্যাণ ছাড়া কল্যাণ করে না। সিঁদুরে মেঘ দেখলে মানুষ আগুনের আশঙ্কা করে। তাই আজ বুয়েটে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির শিক্ষার্থীরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে আশঙ্কা করছে, তাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পারলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা দেশ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। এর জন্য সব শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষা ও তাদের পাঠ্যসূচিতে মানবিক শিক্ষাকে আবশ্যিক করতে হবে। শিক্ষার্থীরা মানবিক হলে বুয়েটে বর্তমান সংকটের অবসান ঘটবে। বিপরীতধর্মী শিক্ষা অন্তরে রেখে আসল শিক্ষা অর্জন করা যায় না। মূল সমস্যার সমাধান না করে কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দিলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এ কারণে সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষা ঢেলে সাজাতে হবে। ব্যর্থতার দায় পরের ঘাড়ে চাপায় দুর্বলরা। সবলরা তা করে না।

লেখক : সাহিত্যিক, সাবেক পরিচালক

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close