ফারিহা হোসেন

  ১৪ মে, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

তাপপ্রবাহে শিশু ও বয়স্কদের জন্য করণীয়

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বের চিরাচরিত গতি-প্রকৃতি বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। একই সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধিতে গলছে বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের পাহাড়, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, উত্তপ্ত হচ্ছে পৃথিবী, বর্তমান সময়ে দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ তাপপ্রবাহের কারণও মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। পাশাপাশি পাহাড়-বন, বৃক্ষ নিধন, বন উজাড়, নদী-খাল-বিল দখল, ভরাট থাকায় পরিস্থিতিকে আরো ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এসবের বিরূপ প্রভাব শুধু জলবায়ু পরিবর্তন ঘটাচ্ছে না, একই সঙ্গে কৃষি, খাদ্য উৎপাদনকে ব্যাহত করছে এবং জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

এমনি অবস্থায় প্রায় মাস ধরে দেশব্যাপী চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। তাপপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে। দেশজুড়ে বয়ে যাওয়া এই তাপপ্রবাহে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তাপমাত্রার এমন পরির্বতন এখন যে হচ্ছে তা নয়, কয়েক বছর ধরে তা হচ্ছে, তবে এবার এর স্থায়িত্ব বেশি হওয়ায় বিষয়টি গুরত্ব পাচ্ছে। এর আগে দেশে ১৫ থেকে ১৩ দিন পর্যন্ত লাগাতার তাপপ্রবাহ থাকার রেকর্ড থাকলেও এবার মাস জুড়েই টানা তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। গরমে অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, নির্মাণকাজ সবকিছুই চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশাচালক, পথশিশু, হকার, ফেরিওয়ালাদের জীবনে যেন এই তাপপ্রবাহ ছিল প্রাণনাশি হুমকি। এই তীব্র তাপমাত্রা বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের নিয়ামকের জন্য একটি বিরাট বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এর সমাধানে বৈশ্বিক আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তবে, সবার আগে প্রয়োজন অধিক পরিমাণে সবুজায়ন, বনায়ন ও জলাভূমি সৃষ্টি ও সংরক্ষণ।

সূর্যের অবিরাম তাপ থেকে বাঁচতে যখন অনেকে তাদের অফিস বা বাড়ির ছায়ায় আশ্রয় খোঁজে, তখন আবার অনেকেই কাঠফাটা রোদে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন-মজুররা কাজ করছে। ফলে এই শ্রেণিপেশার মানুষ এই তাপপ্রবাহে কাবু হচ্ছে বেশি। ফলে তারা দুর্বল এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত শরীরের সঙ্গে লড়াই করে বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছে। বিশেষ করে জ্বর, সর্দি, কাশি, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ডিহাইড্রেশন এবং হিটস্ট্রোকের মতো জটিল অবস্থার শিকার হচ্ছে। তবে নারী-শিশু, বয়স্করা অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, এই তাপপ্রবাহ মানব শরীরের উপযোগী নয়। এতে মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। অনেকে গরম সহ্য করতে না পেরে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুবরণও করেছেন। শুরুতে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ থাকলেও ক্রমে তা তীব্র থেকে অতি তীব্র হয়ে উঠেছে। এমনিতে এপ্রিল বছরের উষ্ণতম মাস; তবে অন্যান্য যেকোনো বছরের চেয়ে অনেক বেশি উত্তাপ ছড়ায় এবারের এপ্রিল মাসটি। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের শরীরও গরম হয়ে যায়। এর ফলে রক্তনালিগুলো খুলে যায়। এর জের ধরে রক্তচাপ কমে যায় যে কারণে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা হৃৎপিণ্ডের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আর রক্তচাপ খুব বেশি কমে গেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। আগে আমরা ঋতু ধরে বলতে পারতাম কখন কী হবে। কিন্তু এখন সেটা বলা সম্ভব নয়। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে না, সারা বিশ্বেই এমন অবস্থা। এ জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এ জন্য প্রধানতম দায়ী। আরেকটা বিষয় হলো শিল্পায়নের আগে যে তাপমাত্রা ছিল, শিল্পায়নের পর তাপমাত্র এক থেকে দেড় ডিগ্রি বেড়ে গেছে। ফলে বিশ্ব ক্রমেই যে উষ্ণতার দিকে যাচ্ছে, সেটা তো আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। এখন তাই হচ্ছে।

চলমান এই তাপপ্রবাহসহ জলবায়ু পরিবর্তনের আরো ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়। অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায়, আমাদের আগে শিশু ও সবচেয়ে অসহায় জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে রাখার প্রতি নজর দিতে হবে। বিশেষ করে নবজাতক, সদ্যোজাত ও অল্পবয়সি শিশুদের জন্য। হিট স্ট্রোক ও পানি শূন্যতাজনিত ডায়রিয়ার মতো, উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে সৃষ্ট অসুস্থতায় শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া আমরা প্রাথমিকভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি, যেমন শিশুরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের বসা ও খেলার জন্য ঠাণ্ডা জায়গার ব্যবস্থা করে দেওয়া। তপ্ত দুপুর ও বিকেলের কয়েক ঘণ্টা তাদের বাড়ির বাইরে বেরোনো থেকে বিরত রাখা। শিশুরা যেন হালকা ও বাতাস চলাচলের উপযোগী পোশাক পরে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সারা দিন তারা যেন প্রচুর পানি পান করে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় অতিরিক্ত ঘামের জন্য শরীর থেকে প্রয়োজনীয় লবণ ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যায়। প্রচুর পানি, পানীয়, স্যালাইন, শরবত, তাজা রসালো ফল, বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। প্রখর রোদ থেকে রক্ষা পেতে ছাতা, হ্যাট/ক্যাপ ও সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে। একটানা দীর্ঘ সময় রোদে কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ে আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী কিছুটা মানবিকতার আচরণ করতেই পারি। সারা দিন রোদে খেটে খাওয়া মানুষদের পারিশ্রমিক সাধ্য অনুযায়ী বাড়িয়ে দিতে পারি। রিকশাচালক বা এই শ্রেণির জনগোষ্ঠীর ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে দিলে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব না আমরা কেউই। সামান্য কিছু খাবার ও বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা করতে পারি। ইতিমধ্যেই এমন অনেক নজির দেখতে পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। যে যেমনভাবে পারছে সাধ্যমতো চেষ্টা করে নিজ নিজ বাসার সামনে ছায়ায় বসার ও বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে, খাবারের পানির ব্যবস্থা পর্যন্ত আছে। বাদ যায়নি এই সহানুভূতি প্রাণীদের প্রতিও। প্রাণীদের এই তীব্র গরমে পানির এবং অন্তত পক্ষে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সুপেয় জায়গা করে দিয়েছে অনেকেই। চলমান এই গতিশীলতাকে স্বাভাবিক রাখতে আমাদেরও এই দুর্দশার জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। মানিয়ে নিতে হবে এ আবহাওয়া এবং ধরে নিতে হবে এটা এক যুদ্ধই। টিকে থাকতে হবে নিজের শেকড় মজবুত করে আঁকড়ে ধরে।

আমরা কিন্তু এখনই ভবিষ্যতের একটা ডেমো দেখতে পাচ্ছি। ঋতুর পরিবর্তন হচ্ছে। গরম দীর্ঘ হয়ে গেছে। বর্ষা সংক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তাপপ্রবাহের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া উৎপাদনশীল খাত কৃষিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। বনভূমি ধ্বংস এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বর্তমান সময়ে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হচ্ছে, তা শুধু একটি সতর্কবার্তা। দ্রুত বনায়নের কাজ শুরু করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রকৃতিবান্ধব জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ওই গবেষণায় ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের প্রতিদিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পর্যালোচনা করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, বিভিন্ন ঋতুতে তাপমাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, ক্রমেই জলবায়ু পরিস্থিতি উষ্ণ হচ্ছে। সব ঋতুতেই তাপমাত্রা আগের চেয়ে বাড়ছে। মনে রাখতে হবে, এই তাপপ্রবাহ চিরকালীন নয়। সবুজ শ্যামল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বাংলাদেশ বইয়ের পাতায় শৈশবে পড়া দিনগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। প্রকৃতি সবুজ, বনবনানি, পাহাড় অরণ্য, নদীনালা খাল বিল অক্ষুণ্ণ রেখেই জীবনকে সাজাতে হবে তবেই রক্ষা পাওয়া যাবে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাব থেকে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, স্থানীয়, রাষ্ট্রীয়, আন্তরাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

শিক্ষার্থী-নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close