মো. জিল্লুর রহমান

  ১৪ মে, ২০২৪

বিশ্লেষণ

যুগে যুগে যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ

যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ নতুন নয়। ২০২০ সালে পুলিশি নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ মারা গিয়েছিল। সে সময় জর্জ ফ্লয়েড বলেছিল, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ তার সেই আকুতি বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তুলেছিল। এবার ৫৩ বছরের ফ্র্যাঙ্ক টাইসন একই ধরনের আকুতি জানিয়েও বাঁচতে পারেননি। মার্কিন সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্যান্টনের একটি ক্লাবে এই বর্ণবাদী ঘটনা ঘটে। পুলিশের কাছে থাকা বডি ক্যামেরার ভিডিও থেকে দেখা গেছে, পুলিশ টাইসনকে মাটিতে ঠেসে ধরে তার হাত পিছমোড়া করে বাঁধে। পরে সেখানে পুলিশের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তিতে গুরুতর আহত হন টাইসন। সেখান থেকে টাইসনকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও তিনি মারা যান। এই ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যকে বেতনসহ বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশের বডি-ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ক্যান্টন পুলিশের এক কর্মকর্তা একটি সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে অ্যামভেস্ট নামের একটি বারে ফ্র্যাঙ্ক টাইসনকে খুঁজে পান। গত ১৮ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে যায়। সেই ঘটনার তদন্তে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাকে বারের বাইরে অবস্থিত এক মোটরসাইকেল আরোহী ইঙ্গিত দেন যে, দুর্ঘটনা ঘটানো ব্যক্তি বারের ভেতরে আছে। এক পুলিশ কর্মকর্তার বডি-ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যায়, একজন মহিলা দরজা খুলে বলেন, ‘দয়া করে তাকে (ফ্র্যাঙ্ক টাইসন) এখনই এখান থেকে সরিয়ে নিন।’ এরপর পুলিশ বারের ভেতরে গিয়ে টাইসনকে পাকড়াও করার চেষ্টা করে। সে সময় টাইসন বারবার পুলিশকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে একপর্যায়ে পুলিশ তাকে বারের মেঝেতে ঠেসে ধরে। এ সময় টাইসন বলতে থাকেন, ‘ওরা (পুলিশ) আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে, কেউ শেরিফকে ডাকো।’

পুলিশ সদস্যরা টাইসনকে তার পিঠের ওপর হাঁটু রেখে এবং দুই হাত চেপে ধরে মাটিতে ঠেসে রেখেছিল। এরপরই টাইসন পুলিশকে বলতে থাকেন, তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা এপির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সে সময় টাইসন বলেছিলেন, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ একপর্যায়ে টাইসন অচেতন হয়ে পড়েন। সে সময় এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, টাইসন শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু অন্য পুলিশ কর্মকর্তা জবাব দেন, ‘সে সম্ভবত মারা গেছে।’ পরে পুলিশ কর্মকর্তারা দেখতে পান, টাইসন আর নড়াচড়া করছেন না। তখন তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের শুরু ষোড়শ শতকে। সেই সময় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের দাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছিল। এরপর প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানকে দাস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। অবশ্য সূচনালগ্ন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ডিপার্টমেন্টগুলো ছিল চরম বর্ণবাদী। ১৯১১ সালে স্যামুয়েল ব্রেটন নামক একজন কৃষ্ণাঙ্গ নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও পরবর্তী সময়কালে সেই সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। পরে নাগরিক অধিকার আইন, ১৯৬৪ পাশের মাধ্যমে চাকরি লাভের ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য অনেকাংশে দূর করা গেলেও, কৃষ্ণাঙ্গরা সর্বক্ষেত্রে ছিল অবহেলিত। ১৯৭০ সালের পরে যেসব কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান পুলিশে সুযোগ পেয়েছিলেন, অবশ্য তারা নিজেরাই কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটিতে ব্যাপক আগ্রাসন ও বর্বরতা চালিয়েছিল, কারণ তাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল ডিপার্টমেন্টে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করা।

বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকান হলেও তারা জন্মগতভাবে কখনোই আমেরিকান ছিলেন না। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যের অনাবাদি জমি চাষ করানোর জন্য আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকানদের আমেরিকান ভূমিতে নিয়ে আসে। বর্তমান আমেরিকান শেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রায় সব সদস্যই ইউরোপীয়, যারা কি না সত্যিকার বহিরাগত। শুধু রেড ইন্ডিয়ানরাই আমেরিকার প্রকৃত আদিবাসী।

আফ্রিকান আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ ও শেতাঙ্গ পুলিশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বেগবান হয় গ্রেট মাইগ্রেশনের সময়কালে, যখন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়গুলোতে দক্ষিণের গ্রামাঞ্চলগুলো থেকে উত্তরের শহরাঞ্চলে পাড়ি জমায়। বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গদের উত্তরের অঙ্গরাজ্যগুলোতে আগমন শেতাঙ্গ কমিউনিটি ও শেতাঙ্গ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কখনোই ভালো চোখে নেয়নি। তাদের মধ্যে সর্বদা একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করত, কৃষ্ণাঙ্গরা স্বভাবতই অপরাধপ্রবণ, অধিক আগ্রাসী ও ভীতিসঞ্চারক! যার ফলে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পুলিশি নজরদারি অধিক করার পাশাপাশি তাদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। পুলিশের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠে কৃষ্ণাঙ্গ থেকে শেতাঙ্গদের রক্ষা করা। শেতাঙ্গ আমেরিকানরা উন্নত জীবনযাত্রার প্রয়াসে দক্ষিণের গ্রামাঞ্চল থেকে যখন আশপাশের শহরগুলোতে পাড়ি জমাত, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি তাদের নির্যাতনে পুলিশ সমর্থন ছিল। তা ছাড়া দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোতে আধিপত্যবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠন ‘ক্লু ক্লক্স ক্ল্যান’ ও সিটিজেন কাউন্সিল কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞে কখনো পুলিশি বাধা আসত না।

১৮৬১ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দল থেকে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নিলে উত্তরাঞ্চলের সাতটি রাজ্য একত্রে ইউনিয়ন স্টেটের শক্তি নিয়ে প্রতিপক্ষ দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি রাজ্যের কনফেডারেশনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। দাসত্ব প্রথা বিলোপের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান, মূলত এটিই ছিল আমেরিকার গৃহযুদ্ধের কারণ। গৃহযুদ্ধে বিজয় লাভের পর আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি; এর জের ধরে ১৮৬৫ সালে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

আব্রাহাম লিংকনের হত্যাকাণ্ডের প্রায় একশো বছর পর কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে মার্টিন লুথার কিং তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ শিরোনামে একটি যুগান্তকারী ভাষণ দেন। এরপর মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বাধীন তীব্র আন্দোলনের ফলে ১৯৬৪ সালে যখন আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নাগরিক অধিকার আইন আর ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন পাস হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন উগ্র শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে বাধ্য করা কোনো আইন না মেনে নেওয়ার ঘোষণা করেছিল। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থি সন্ত্রাসীদের গুলিতে মার্টিন লুথার কিং নিহত হন। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং নিপীড়ন থেকে বাঁচার যে প্রত্যাশা করেছিলেন, সেটি আমেরিকান সমাজে এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ সোচ্চার হলেও জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ প্রকাশিত ‘দ্য ইউএন ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিপেনডেন্স এক্সপার্ট মেকানিজম টু অ্যাডভান্স রেসিয়াল জাস্টিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটি ইন দ্য কনটেক্সট অব ল এনফোর্সমেন্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেশটির অভ্যন্তরে মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম নেতিবাচক দিক উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে পদ্ধতিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ। যে বর্ণবাদের প্রধান শিকার আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গরা। গত বছরের শুরুতে জাতিসংঘের বর্ণবাদবিষয়ক বিশেষজ্ঞ দলের যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। বিশেষজ্ঞরা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের শিকার ১৩৩ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তারা ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া, আটলান্টা, লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগো, মিনিয়াপোলিস ও নিউ ইয়র্কে পাঁচ শহরের পাঁচটি বন্দিশিবির পরিদর্শন করেন। শুধু তাই নয়, তারা ওই পাঁচ শহরের নাগরিক সমাজ, সরকার ও পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিশেষজ্ঞ দলের অন্যতম একজন সদস্য বলেন, ‘আমরা যেসব শহরে গেছি, সেখানে আমরা (বর্ণবাদের) কয়েক ডজন হৃদয়বিদারক কাহিনি শুনেছি। বর্ণবাদ একটি পদ্ধতিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা যা পদ্ধতিগতভাবেই সমাধান করা দরকার।’

প্রতিবেদনের প্রতিটি পৃষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রে ভয়ংকর বর্ণবাদের চিত্র উঠে এসেছে; যা নির্মম দাসপ্রথা, দাস ব্যবসা ও শত শত বছরের আইনসিদ্ধ বর্ণবাদের উত্তরাধিকারই বহন করে চলেছে। এমনকি দাসপ্রথার বিলুপ্তির দেড় শ বছর পরও জাতিগত নিপীড়ন, পুলিশি হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন আজও ব্যাপকভাবে বিদ্যমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই বর্ণবাদের সবচেয়ে বড় শিকার আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গরা। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার আশঙ্কা তিন গুণ বেশি এবং কারাবন্দি হওয়ার শঙ্কা ৪ দশমিক ৫ গুণ। আরো বলা হয়েছে, প্রতি বছর পুলিশের হাতে এক হাজারেরও বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

চলতি বছরের মার্চে সংবাদ সংস্থা এপির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিগত ১ দশকে পুলিশের নির্যাতন ও অন্যান্য কারণে পুলিশি হেফাজতে যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। যদিও পুলিশের নির্যাতনের কোনো অধিকার মার্কিন আইন দেয় না। এর বিপরীতে বিচারের আওতায় আসে মাত্র ১ শতাংশ পুলিশ কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, যদি যুক্তরাষ্ট্রে শক্তি প্রয়োগের আইন বা বিধিবিধান আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংস্কার করা না হয়, তাহলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড যুগে যুগে চলতেই থাকবে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close