ড. রাহমান নাসির উদ্দিন
মতামত
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত নেই!
মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কিছু রথী-মহারথী বাংলাদেশে আসেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করেন এবং যাওয়ার আগে আমাদের কিছু জ্ঞান বিতরণ করেন। ভাগ্যাহত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর থেকে বিভিন্ন দেশের রাজা-রানি-রাজকুমারীরা আসেন তাদের দেখার জন্য। যেন রোহিঙ্গা একটা ‘দেখার জিনিস’! মাঝে মাঝে মানুষের ‘অসহায়ত্ব’ এবং ‘করুণাবস্থা’ও যে দেখার জিনিস, বেচারা রোহিঙ্গারা তার নগদ নজির! মাঝে মাঝে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান আসেন। ভ্রমণ শেষে একটা রুটিন দায়িত্ব অনুযায়ী প্রেস কনফারেন্স করেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা অধির আগ্রহ নিয়ে নানা প্রশ্ন করেন। নানা প্রশ্নের মধ্যে বহুমাত্রিকতা থাকলেও একটা প্রশ্ন প্রায় কমন থাকে : রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কী?
সবাই ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা কথা বলে এর উত্তর দেন, কিন্তু কার্যকর সমাধানের কোনো ইশারা বা ইঙ্গিত দেন না বা বলতে পারেন না কিংবা সমাধানের কোনো ফর্মুলা দিতে পারেন না। অনেক কথা বলেন বটে, কিন্তু আসল কথাটা বলেন না কিংবা বলতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘অনেক কথা যাও যে বলি কোনো কথা না বলি, তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি’। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বা আইওএমের মহাপরিচালক অ্যামি পোপও একই ‘রবীন্দ্রসংগীত’ গেয়ে গেলেন। অনেক কথা বললেন, কিন্তু আসল কথাটাই বললেন না। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো আশা নেই, আলোও নেই। আছে শুধু আলো-আঁধারির মাঝখানে আশা-ভরসার অন্তহীন খেলা। ফলে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনের কবে ইতি ঘটবে, তার কোনো দিশা নেই। জেনোসাইডের শিকার যে মানুষগুলো শরণার্থীশিবিরে সীমাহীন অনিশ্চয়তা নিয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছে, তাদের জন্য কোনো আশার বার্তা নেই।
আইওএম যেহেতু রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির ব্যবস্থাপনার অন্যতম অংশীজন এবং বিশ্বব্যাপী শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেহেতু আইওএমের মহাপরিচালক অ্যামি পোপ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কী বলছেন, কী ধরনের চিন্তাভাবনা করছেন এবং কী ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন সেটা জানা জরুরি রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে যেকোনো ধরনের গঠনমূলক আলোচনার জন্য। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী অ্যামি পোপ বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরের নারী ও শিশুরা ব্যাপক অনিরাপত্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বিশেষ করে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, রাতে ঘুমানোর সময় তাদের ঘর বন্ধ করার ব্যবস্থাও নেই। তা ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে নারী ও শিশু পাচার ঠেকানোর মতো যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই।’ এসব আলোচনা মোটামুটি কমন সংলাপ। আমরা শুনে শুনে আমাদের কানগুলো এ ধরনের বক্তব্যের শব্দণ্ডচয়ন ও বাক্য-বিন্যাসের সঙ্গে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ তার সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং আন্তরিকতা দিয়ে রোহিঙ্গাদের একটা বাসযোগ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার চেষ্টা করলেও আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এর কর্তাব্যক্তি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রায় মুখস্থ বলে দেয় এসব কথা। সুতরাং এর মধ্যে তেমন নতুনত্ব নেই।
এটা স্বীকার্য যে, সব রোহিঙ্গা যথেষ্ট ভালো অবস্থায় নেই, তারা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় দিনাতিপাত করছে- এ রকম পাইকারি ও মুখস্থ কথাও বলা যাবে না। রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের জন্য এবং শরণার্থীশিবির পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সহযোগিতা ক্রমান্বয়ে কেন কমে যাচ্ছে- এই প্রশ্নের উত্তরে অ্যামি পোপ বলেন, ‘চলমান যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে দাতা সংস্থাগুলো ক্রমেই মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে দৃষ্টি হারাচ্ছে। তা ছাড়া দাতা সংস্থাগুলো ফিলিস্তিন আর ইউক্রেন সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী মানবিক সাহায্য অব্যাহত রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এখন যদি দাতারা তাদের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়, তাহলে রোহিঙ্গাদের না খেয়ে থাকতে হবে। এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই যাতে রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য বন্ধ না হয়ে যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করছে আইওএম।’ সেই একই মুখস্থ কথা।
ফিলিস্তিন এবং ইউক্রেনের সংকটের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি এবং এ চলমান সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে, এসব ব্যাখ্যাও শুনতে শুনতে আমাদের রীতিমতো মুখস্থ হয়ে গেছে। এটা জানার জন্য অ্যামি পোপের বয়ানের দরকার নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কিংবা পশ্চিমা ধনবাদি বিশ্ব নিশ্চয় এটা ধরে নিয়ে বসে নেই যে, রোহিঙ্গাসংকটের পর আর কোনো সংকট পৃথিবীতে আসবে না। সুতরাং তাদেরও সে প্রস্তুতি থাকা উচিত, যেকোনো সময় যেকোনো দেশে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে (যার অধিকাংশ তারা নিজেরাই তৈরি করে!)। তাই বলে নতুন সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে পুরোনো সংকটকে ভুলে যাব, এটা কোনো কাজের কাজ না। মানবতার ডিলারদের এ ধরনের অমানবিক কথা মানায় না! আমাদের চর্বিতচর্বণ সবক না দিয়ে, আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য কীভাবে নিয়মিত করা যায় এবং রোহিঙ্গাদের চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেওয়া যায়, সেদিকে অধিকতর মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতেও প্রধানমন্ত্রী বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল আরো বাড়াতে জাতিসংঘের আইওএমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ লেখক নজরুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন উৎস থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় আরো তহবিল সংগ্রহের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন আইওএমের এই প্রতিনিধিকে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু (বাংলাদেশে) মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য তহবিল কমে গেছে, আইওএমের উচিত এই উদ্দেশ্যে আরো তহবিল সংগ্রহের জন্য নতুন অংশীদারদের খুঁজে বের করা।’ ১৩ লক্ষাধিক শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া একটি দেশের সরকারপ্রধানের পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়েও আমরা নতুন কিছু অ্যামি পোপের মুখে শুনিনি।
সম্ভাব্য প্রত্যাবাসন নিয়ে তিনি বলেন, ‘কেউই বাস্তুচ্যুত হয়ে থাকতে চায় না। মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা না হলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার আলোচনা তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার শামিল। মিয়ানমারে শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান হতে পারে। শান্তি স্থাপন না হলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠালে সেটা নিরাপদ হবে না।’ এখানেও আমরা নতুন কিছু পাইনি। যেই লাউ, সেই কদু! মিয়ানমারে কবে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে, আদৌ কখনো হবে কি না, তার যেহেতু কোনো মা-বাপ নেই, সেহেতু তৃতীয় কোনো দেশে (থার্ড কান্ট্রি রিসেটেলমেন্ট) রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করানো যায় কি না, তা নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সম্প্রদায়ের নেই। সব কথার সারকথা হচ্ছে, ২০১৭ সালের পর থেকে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা নিয়ে এর ভরণপোষণ ও দেখভাল করছে। প্রায় ৭ বছরের কিনারে এসে সেটা সংখ্যায় এখন প্রায় ১৩ লক্ষাধিক হয়ে উঠেছে। একদিকে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে, তাদের চাহিদা বাড়ছে এবং নতুন নতুন সংকটের জন্ম নিচ্ছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তার পরিমাণ ক্রমহ্রাসমান। জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের চাহিদা অনুযায়ী এখন ৫০ শতাংশ আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাও পাওয়া যায় না। ফলে রোহিঙ্গাদের চাহিদার তুলনায় জোগানের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশকেও নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে অর্থাৎ জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে শরণার্থীশিবির পরিচালনা করতে হচ্ছে। মাঝখান দিয়ে সবকিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হতভাগা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তাদের ন্যূনতম জীবন ধারণের সুযোগ ও সুবিধাগুলো সংকোচিত হচ্ছে। এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো আওয়াজ নেই। মিয়ানমার নিজের অভ্যন্তরীণ সিভিলওয়ার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। চলমান সিভিলওয়ারের সূত্র ধরে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য মোটামুটি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দিচ্ছে না। ফলে রোহিঙ্গারা যে রাখাইনে ফিরে যাবে তারও কোনো সম্ভাবনা দেখছে না। এদিকে উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্ঠীও রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটা ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে। ফলে স্থানীয় ও সামাজিকভাবে রোহিঙ্গাদের আত্মীকরণের কোনো সম্ভাবনাই নেই। সার্বিক বিবেচনায় রোহিঙ্গারা পড়েছে ত্রিমুখী সংকটে। নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ খুবই সংকীর্ণ, যে দেশে আছে সে দেশে আত্মীকরণের কোনো সম্ভাবনাই নেই এবং শরণার্থীশিবিরেও কোনো রকমে বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ ও সুবিধাগুলো আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার কারণে ক্রমহ্রাসমান।
এ রকম পরিস্থিতি আইওএমের মহাপরিচালকের কথার মধ্যে আমরা কোনো দিশা পেলাম না। রোহিঙ্গাদের জন্যও কোনো আশার আলো নেই। সে একই ‘স্ক্রিপ্ট’ প্রায় মুখস্থ বলে যাওয়ার মতো। আমি মনে করি, রুটিনওয়ার্কের বাইরে আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এসব সংস্থার কর্মকর্তাদের সক্রিয়ভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের দিকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কিছু পিরিউক্যাল ভিজিট (সময়ান্তরে ভ্রমণ) এবং কিছু কমন স্ক্রিপ্ট (একই লেখ্য ধরন) মুখস্থ বলে দেওয়ার মধ্যে আখেরে বাংলাদেশের জন্যও কোনো লাভ নেই, রোহিঙ্গাদের জন্যও কোনো আশার আলো নেই। রোহিঙ্গা সমস্যার একটি টেকসই ও মজবুত সমাধান নিয়েই আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। আমাদের এখন কথার চেয়ে কাজ বেশি প্রয়োজন।
লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"