গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
মুক্তমত
ভুল হলে ক্ষমা চাও
ভুল করাটা মানুষের স্বাভাবিক বিষয় বা বৈশিষ্ট্য। প্রথম মানব আদম (আ.) থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব মানুষের দ্বারাই ভুল ত্রুটি হয়েছে। পাপের পথে জীবনে কখনো না কখনো মানুষ মাত্র পা দিয়েছে বা গিয়েছে।
মানুষকে মহান আল্লাহ ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সেই স্বাধীনতা দিয়ে মানুষ পাপের পথে গিয়েছে, আবার পুণ্যের পথেও এসেছে। ইবলিস আর আদমের পার্থক্য এটাই, মানুষ ভুল করে আবার ক্ষমাও চায়। অনুতপ্ত হয়। কিন্তু ইবলিস তা করে না। এ কথাগুলোই কিন্তু আমরা হাদিস থেকেই জানতে পারি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ মাত্রই গুনাহগার। আর গুনাহগারদের মধ্যে তওবাকারীরাই হচ্ছে উত্তম।’ (তিরমিজি : ২৪৯৯)
পাপ হয়ে গেলে আমাদের করণীয় হচ্ছে সেই ভুল থেকে অনুতপ্ত হৃদয়ে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করা। তওবা করা। ওই ভুল আর জীবনে দ্বিতীয়বার না করার ওয়াদা করা। এটুকু আমরা অনেকেই করি, সঙ্গে আরেকটি ভুলও করি। সেটা হচ্ছে আমরা যে এত দিন ভুল করে এসেছি, পাপ করে এসেছি, সেই ভুল বা পাপকে প্রকাশ করে বেড়ানো।
বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার এ যুগে আমরা অনেকেই নিজের পূর্ব জীবনের কৃত ভুলকে বা পাপকে খুব রসিয়ে রসিয়ে প্রচার করে বেড়াই! পূর্ব জীবনে কী করেছি, কোথায় করেছি বা কীভাবে করেছি ইত্যাদি। আর অনেকেই এগুলো করে ‘দ্বীনে ফেরা’ নামক বয়ানের মাধ্যমে! আবার নানা রেডিওতে জীবনের গল্প নামেও এসব ঘটা করে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। অথচ এটা ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিবিরোধী কাজ। আমরা পূর্ব জীবনে ভুল করেছি মানে তো সে ভুলের জন্য রাব্বুল আলামিনের দরবারে অনুতপ্ত থাকব।
পাপ প্রকাশ করা মানে সেটার ব্যাপারে মানুষকে সাক্ষী বানিয়ে নেওয়া। মানুষ যখন পাপের সাক্ষী হয়ে যায়, তখন সেই পাপ কিন্তু সহজে ক্ষমাযোগ্য হয় না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে তার বান্দাদের উদ্দেশে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গুনাহ পরিত্যাগ করো।’ (সুরা আনআম : ১২০)
এখন আপনি পাপ প্রকাশের মাধ্যমে আল্লাহর দুটো আদেশ অমান্য করেছেন। একটা হচ্ছে পাপ করেছেন, তা এখন করেছেন অথবা পূর্বে করেছেন, সেটা গোপনে বা প্রকাশ্যে। তো পাপ করার মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে একটা ভুল করেছেন। আবার সেটিকে প্রকাশ করে আরেকটি অন্যায় করেছেন। আপনি এটা প্রকাশের আগে এত মানুষ জানত না, যা এখন জানে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা কোনো মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না।’ (সুরা নিসা : ১৪৮)
এখন যেখানে আল্লাহ নিজেই মন্দ বিষয় প্রকাশ পছন্দ করেন না, সেখানে আপনি কী জন্য মন্দের প্রকাশ ঘটান? পাপ করে সেটা প্রকাশ ও প্রচার করা অনেক বড় একটি গুনাহ। আপনার আগের কৃত গুনাহটি যদি ছোট গুনাহ হয়, প্রকাশ করার ফলে এটি বড় গুনাহে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কিন্তু এ ধরনের ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার সব উম্মতকে মাফ করা হবে, তবে প্রকাশকারী এর ব্যতিক্রম। আর নিশ্চয়ই এটা বড় অন্যায় যে, কোনো লোক রাতে অপরাধ করল, যা আল্লাহতায়ালা গোপন রেখেছেন। কিন্তু সে সকালে মানুষের কাছে বলে বেড়াতে লাগল, হে অমুক! আমি আজ রাতে এই এই কাজ করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত কাটাল যে আল্লাহ তার পাপকর্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার ওপর আল্লাহর দেওয়া আবরণ খুলে ফেলল।’ (বোখারি : ৬০৬৯)
মহান আল্লাহ পাপ প্রকাশকারীর ব্যাপারে এত কঠোর কেন? কেন তিনি প্রকাশকারীকে ক্ষমা না করার ঘোষণা দিয়েছেন? এর কারণ হচ্ছে, একে তো আপনি গুনাহ করেছেন, আবার মুমিনদের মাঝে প্রকাশ বা প্রচারও করছেন সেই গুনাহকে। হয়তো এর মাধ্যমে আপনি নিজেকে ফুটিয়ে তোলা বা নিজেকে প্রচারের সুপ্ত ইচ্ছা পোষণ করে আছেন, বা একটুখানি ভাইরাল হওয়ার আকাঙ্ক্ষাতেই তা করছেন। আর নিজেকে প্রকাশ করার এ অনাকাঙ্ক্ষিত আকাঙ্ক্ষাটা হলো এক প্রকার প্রদর্শনেচ্ছা। অথচ পাপের মাধ্যমে নিজেকে প্রদর্শন করা, প্রচার করা তো ভদ্রতা বিনয়হীনতার প্রমাণ।
ধরুন, দুনিয়ার জীবনে আমরা কেউ বড়দের আদেশ অমান্য করলাম বা বেয়াদবি করলাম, তখন কি আমাদের ভেতর অনুশোচনা বা অনুতাপ আসে না? আমরা লজ্জিত থাকি না সেটা নিয়ে? অথচ মানুষের চেয়ে আল্লাহর গায়রত বা আত্মমর্যাদাবোধ অনেক গুণ বেশি। সে কারণেই তিনি সর্বপ্রকার অশ্লীল ও পাপ কাজ হারাম করেছেন। (মুসলিম : ২৭৬০)
সুতরাং আমাদের পাপের কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে, আর অচেতন মনে পাপ হলেও প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা, আদব-কায়দা মেনে চলা উচিত।
লেখক : ধর্ম ও সমাজবিশ্লেষক, সাংবাদিক ও চেয়ারম্যান, গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা
"