বিশ্বজিৎ ঘোষ

  ০৮ মে, ২০২৪

শ্রদ্ধাঞ্জলি

অশেষ রবীন্দ্রনাথ

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাবয়িত্রী এবং কারয়িত্রী প্রতিভার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথকে আমি স্রষ্টা এবং কর্মযোগী মানুষ হিসেবেই দেখতে ভালোবাসি। জন্মের পর এক শ বাষট্টি বছর অতিক্রান্ত, মৃত্যুর পরও আমরা পেরিয়ে এসেছি বিরাশি বছর, তবু বাংলাভাষী মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের অব্যাহত প্রভাব দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। তার সাহিত্যকর্মের পরিমাণ বিপুল, লিখেছেন তিন হাজারের অধিক গান, এঁকেছেন দুই সহস্রাধিক ছবি, প্রতিষ্ঠা করেছেন মানবকল্যাণমূলক অনেক প্রতিষ্ঠান।

দ্বিমাত্রিক এই প্রয়াস এবং উদ্যোগের কথা স্মরণে রেখেই আমি দেখতে চাই, ভাবতে ভালোবাসি রবীন্দ্রনাথকে। যাকে বলব বহুমাত্রিক সাহিত্যপ্রতিভা- রবীন্দ্রনাথ তার উজ্জ্বল উদাহরণ। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, ছড়া, ব্যক্তিগত রচনা, ভ্রমণসাহিত্য, চিঠিপত্র, সংগীত কোন রূপকল্পে না লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ? বাংলা কবিতাকে প্রাদেশিকতার সীমানা ছাড়িয়ে তিনি করে তুলেছেন আন্তর্জাতিক, বাংলা ছোটগল্পের নির্মাতা তিনি, বাংলা উপন্যাসে তিনিই প্রথম দিয়েছেন আধুনিকতার স্পর্শ। নাটকের ক্ষেত্রে তার অবদান ঐতিহাসিক।

আধুনিক বর্ণনামূলক নাটকের পথিকৃৎ তিনি। সংগীত, চিত্রকলা, ভ্রমণসাহিত্য, চিঠিপত্র, ভাষাতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধ, ব্যক্তিগত রচনা- সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথের ভুবনবিজয়ী হাতের স্পর্শ এখনো আমাকে বিস্ময়াভিভূত করে রাখে। সৃষ্টি প্রয়াসে তিনি নিজেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছেন- পৌনঃপুনিকভাবে বাঁকবদল করেছেন আপন চিন্তাধারা ও রূপকল্পের।

অশেষ রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য-প্রতীচ্যের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা পরমজ্ঞানে আত্তীকরণ করে রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করেছেন বাঙালি সংস্কৃতির চিয়ারত এক রূপ।

সুদীর্ঘ সাধনায় সংস্কৃতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন, তা জন্ম দিয়েছে নতুন এক সংস্কৃতি, যার নাম দেওয়া যায় ‘রবীন্দ্রসংস্কৃতি’। রবীন্দ্রসংস্কৃতি বৃহৎ অর্থে গভীর ব্যঞ্জনায় আধুনিক বঙ্গসংস্কৃতিরই পরিমার্জিত রূপ। বঙ্গসংস্কৃতি, ভারতসংস্কৃতি, বিশ্বসংস্কৃতি তথা মানবের শাশ্বত সংস্কৃতিস্রোতে অবগাহন করেই স্নাত হয়ে আবির্ভূত হয়েছে রবীন্দ্রসংস্কৃতি। বিভিন্ন সূত্র থেকে অবলীলায় গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ এবং ক্রমে নির্মাণ করেছেন তার স্বতন্ত্র প্রত্যয়। বিভিন্ন উৎস থেকে গ্রহণ করেছেন বলেই দুর্দিনের অন্ধকারে দীপশিখার মতো উজ্জ্বল রবীন্দ্রসংস্কৃতি।

বাঙালির মুখে তিনি ভাষা জুগিয়েছেন, বুকে দিয়েছেন ভরসা, চোখে পরিয়েছেন স্বপ্নকাজল আর চিত্তে সঞ্চার করেছেন আত্মবিকাশের অফুরান বাণী।

শিল্পস্রষ্টা এই রবীন্দ্রনাথের পাশেই আছেন আরেক রবীন্দ্রনাথ- সেই রবীন্দ্রনাথই এখন আমার কাছে বেশি জরুরি। এখানে তিনি সমাজসংস্কারক। এই রবীন্দ্রনাথ পল্লী উন্নয়নে উদ্যমী, এই রবীন্দ্রনাথ গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে সদা সচেষ্ট। এখানে তাকে দেখি কৃষি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে, ক্ষুদ্রঋণ ধারণার পথিকৃত্রূপে, শ্রীনিকেতনে সমাজ উন্নয়ন চিন্তক হিসেবে, তাকে দেখি গ্রামীণ নারীদের বৃত্তিমূলক জ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে, দেখি পরিবেশসচেতন একজন দার্শনিকরূপে। গ্রাম উন্নয়নের জন্য কত কাজই না তিনি করেছেন। সেসব কাজ এত বছর পরেও এতটুকু প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। শিক্ষাচিন্তক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এখনো আমার কাছে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব। তার কাছেই প্রথম শুনেছি, শিক্ষা হচ্ছে প্রযুক্তি। শিক্ষাকে প্রযুক্তি হিসেবে গ্রহণ করে তিনি মানব উন্নয়নের আহ্বান জানিয়েছেন, যা আমাদের জন্য এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।

মানবাত্মার মুক্তির জন্য রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবের পাশে দাঁড়িয়েছেন- কখনো আফ্রিকার পক্ষে পঙ্ক্তি নির্মাণ করেছেন, কখনো বা কবিতায় ব্যঙ্গের বাণ নিক্ষেপ করেছেন জাপানি সমরবাজদের বিরুদ্ধে। আফ্রিকায় ফ্যাসিবাদী উন্মত্ততার বিরুদ্ধে দাঁড়ান যে রবীন্দ্রনাথ, সেই রবীন্দ্রনাথ এখন আমাদের জন্য বেশি জরুরি। কেননা ওই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমরা শুনি সভ্যতার নামে মানুষের চরম অমানবিকতার কথা, দেখি সাম্রাজ্যবাদী-ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের চরম রূপ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদের ক্রমাগত ঔদ্ধত্যে রবীন্দ্রমানস যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েছে- স্পেন ও চীনে মানবতার বিপর্যয়ে কবির চিত্তে জেগেছে প্রবল আলোড়ন। স্পেনে ফ্যাসিস্ট অভ্যুত্থানে তিনি হন মর্মাহত। স্পেন প্রজাতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে পপুলার ফ্রন্টের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট শক্তির যুদ্ধের পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন জাপানি সমরবাজদের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদণ্ডফ্যাসিবাদবিরোধী এই রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে এখন বেশি জরুরি, বেশি প্রাসঙ্গিক।

মানবতার মুক্তিসাধক যে রবীন্দ্রনাথ, সেই রবীন্দ্রনাথই এখন আমাদের জন্য বেশি প্রয়োজন। মানবতার শত্রুরা, পরাজিত হায়েনারা মানবতার বিরুদ্ধে দেশে দেশে নানা অপকর্মে লিপ্ত, নানা ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশেও সেই হাওয়া বইছে প্রবলভাবে। ওদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তাই রবীন্দ্রনাথ এখন আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্মের নামে অনেক ভণ্ড রাজনীতিক-সমাজসেবক মানবতার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে, যেমন নিঃশ্বাস ফেলেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকের রঘুপতি। আমাদের ঘরে-বাইরের ওই রঘুপতিদের রোখার জন্যই সার্বভৌম কবি রবীন্দ্রনাথ এখন অতি জরুরি এক হাতিয়ার।

রবীন্দ্রনাথ কেন অপরিহার্য? এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য এবং অব্যাহতভাবে প্রাসঙ্গিক- কেননা আমাদের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ নির্মাতা তিনি, আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্যতম উদগাতা তিনি। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, কি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথ এক শানিত হাতিয়ার। তিনি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অফুরান শক্তি জুগিয়েছেন। ষাটের দশকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের উল্লেখযোগ্য শক্তি-উৎস। মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের চিত্তে সঞ্চার করেছে অফুরন্ত সাহস। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি দিনও কি চলে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে? যাকে বাদ দিয়ে চলে না আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি দিনও, চলে না আমাদের কোনো আচার-অনুষ্ঠান-উৎসব, যিনি আমাদের সাহস জোগান, বুকে দেন ভরসা- তিনি যে আমাদের জন্য অব্যাহতভাবে প্রাসঙ্গিক, সে কথা লেখাই বাহুল্য।

আমাদের প্রয়োজনেই রবীন্দ্রশক্তিকে আজ সচেতনভাবে ব্যবহার করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তির পক্ষে অতুলনীয় এক শক্তি। শান্তির অন্বেষায় রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেখাতে পারেন যথার্থ পথ। একলা আমির বন্ধন ছিন্ন করে রবীন্দ্রনাথ আমাদের ডাক দিয়েছেন বহু আমির প্রাঙ্গণে। বর্তমান সময়ে মানুষে মানুষে যে চরম বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছে, মানব সম্পর্কগুলো যে ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ সে ক্ষেত্রে আমাদের কাছে হয়ে উঠতে পারেন উত্তরণের এক মহাশক্তি। মানুষকে তিনি ডাক দিয়েছেন বৃহত্তর ঐক্যের পতাকাতলে। আজকে বিচ্ছিন্নতাপীড়িত এই সময়খণ্ডে সেই ঐক্যের ডাকই এখন আমাদের জন্য বেশি জরুরি এবং এখানেই রবীন্দ্রনাথের কালোত্তীর্ণ প্রাসঙ্গিকতা। মানবাত্মার মুক্তিসাধনায় তিনি আমাদের কাছে শাশ্বত অনুপ্রেরণা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী চিন্তক। দীর্ঘ আশি বছরের অবিরল সাধনায় তিনি উচ্চারণ করেছেন মানবমুক্তির মাঙ্গলিক বাণী। ব্যুয়র যুদ্ধ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড থেকে আরম্ভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য পর্যায় পর্যন্ত যখনই বিশ্ব মানবসমাজের কোনো অংশ অত্যাচারী শাসকে হিংস্র আগ্রাসনের শিকার, তখনই পৃথিবীর কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত, বিশ্বমানবিকতার অপ্রতিম প্রতিনিধি নিয়তজাগর রবীন্দ্রনাথ তখনই প্রতিবাদে মুখর, দ্রোহিতায় শানিত। আমার রবীন্দ্রনাথ এই প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ, এই দ্রোহী রবীন্দ্রনাথ। আমার রবীন্দ্রনাথ বিপুল শক্তি ও অনন্ত সম্ভাবনায় সমুদ্রের মতো বিশাল, আকাশের মতো সর্বত্রবিস্তারী, সূর্যের মতোই তার দীপ্তি, উত্তাপ ও ঔজ্জ্বল্য। জীবনের সব সীমাবদ্ধতাণ্ডভ্রান্তি নিয়েই আমার রবীন্দ্রনাথ মানুষের চিরকালীন স্রোতে অসামান্য এক নাম।

তিনি অশেষ, তিনি অসীম- তিনি রবীন্দ্রনাথ।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close