প্রকাশ ঘোষ বিধান

  ০৭ মে, ২০২৪

মুক্তমত

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা প্রয়োজন

অতিরিক্ত শব্দ মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। লাগামহিন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। লাগাম যেন পরানো যাচ্ছে না। শব্দদূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। ঢাকা শহর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, এমনকি উপজেলা শহরেও বিভিন্নভাবে শব্দদূষণের

মাত্র বাড়ছে। সাধারণত একজন সুস্থ মানুষের শব্দের সহনীয় মাত্রা ৫০ ডেসিবল। এর অতিরিক্ত শব্দ মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মানবস্বাস্থ্যের জন্য শব্দদূষণ

নীরব ঘাতক। জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে পরিবেশে ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার ৪৫টি এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা অনেক বেশি। গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকার রাস্তার বিভিন্ন ট্রাফিক পয়েন্ট, শিল্প এলাকা, বাণিজ্যিক, আবাসিক, মিশ্র ও নির্জন এলাকায় মাত্রা ছাড়িয়ে শব্দদূষণ হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশের এলাকার জন্য সহনশীল মাত্রা ৫০ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হলেও সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা ৭০ ডেসিবল। শুধু এখানেই নয়, ঢাকার সব হাসপাতাল ও স্কুল-কলেজের পাশের এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা ছাড়িয়েছে। অন্যান্য স্থানে এর চেয়ে বেশি শব্দদূষণ রয়েছে। ঢাকা শহরে শব্দদূষণের প্রধান উৎস যানবাহনের হর্নের অতিরিক্ত শব্দ। এ ছাড়া যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ন অতিরিক্ত শব্দ ঘটাচ্ছে। শুধু যানবাহনের হর্ন নয়, বিভিন্ন কারখানা, নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি, রাস্তার পাশে দোকানগুলোতে উচ্চৈঃস্বরে চালানো অডিও-ভিডিও, প্রচার মাইকিং, অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত লাউড স্পিকারসহ সব মিলিয়ে শব্দদূষণ মাত্রা ছড়াচ্ছে। শব্দদূষণের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করায় এর শিকার হচ্ছেন আবাসিক এলাকার বাসিন্ধারা। একই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালের সেবাদানে বিঘ্ন ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, শব্দদূষণ মানবস্বাস্থ্যের জন্য এক নীরব ঘাতকব্যাধী। একই জায়গায় দীর্ঘক্ষণ অবস্থানের ক্ষেত্রে মানব শরীরের জন্য শব্দের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল। কার্যত শব্দদূষণের মাত্রা এর তুলনায় অনেক বেশি।

আরো জানান, নিয়মিত শব্দদূষণের মধ্যে বসবাসের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি ক্ষয় ও কাজের আগ্রহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি অসহিষ্ণুতা বাড়ে। এ তো ঢাকা শহরের সামান্য চিত্র। শব্দদূষণের মাত্রা ছড়াচ্ছে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরে। এমনকি গ্রামের হাটবাজারেও শব্দদূষণের মাত্রা অতিক্রম করেছে। উপজেলা আঞ্চলিক সড়কগুলোতে ইঞ্জিনচালিত ভ্যান ও ট্রলি বিকট শব্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানে শব্দদূষণের প্রধান উৎস ইঞ্জিন ভ্যান। এ ছাড়া ইটভাঙা মেশিন, উচ্চ শব্দে প্রচার মাইকিং, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত লাউড স্পিকার, গাড়ির হর্ন, রাস্তার পাশে উচ্চৈঃস্বরে অডিও-ভিডিও বাজানো, নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, নদীতে ট্রলারের ভট ভট আওয়াজ ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিত্যদিন শব্দদূষণের মাত্রা ছড়াচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর আওতায় শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬-এর প্রয়োগসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬-এর যানবাহনের সাইলের পাইপ থেকে ৭.৫ মিটার দূরত্বে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ ডেসিবল। যানবাহনের চালকরা আইন ভেঙে অতিরিক্ত মাত্রার হাইড্রোলিক হর্ন

ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দদূষণ করছে। শব্দদূষণ ও এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, বিধিমালা অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ও শব্দদূষণ মাপার যন্ত্র ব্যবহার করা দরকার। এর পাশাপাশি শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে।

আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই। যেকোনো ধরনের শব্দের ক্ষেত্রে কান অত্যন্ত সংবেদনশীল। সাধারণত ৫০ ডেসিবলের মাত্রাতিরিক্ত শব্দ মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। উচ্চ শব্দের কারণে মানুষের মাথাব্যথা, ঘুমের ব্যাঘাত, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, কাজে মনোসংযোগের ব্যাঘাত ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়, যা মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া শব্দদূষণের কারণে মানুষের শ্রবণক্ষমতা কমে যায়। হঠাৎ উচ্চ শব্দের কারণে হৃদরোগীদের তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবলের শব্দ মানুষের সাময়িক বধিরতা তৈরি করতে পারে এবং ১০০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে আধঘণ্টা থাকতে পুরোপুরি বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেখানে বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে শব্দের গড়মাত্রা ৬০-৮০ ডেসিবলের মতো। যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ন থেকে সৃষ্ট শব্দ ৯০-৯৫ ডেসিবেল হয়ে থাকে। আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চালানো মাইক ও লাউড স্পিকার থেকে সৃষ্ট শব্দ গড়ে ৯০-১০০ ডেসিবল হয়ে থাকে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। হিসাব মতে, বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে শব্দের দূষণমাত্রা ‘হু’ কর্তৃক স্বীকৃত সিসার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। কর্মজীবী মানুষকে নিয়মিত কর্মক্ষেত্রে ৮০ ডেসিবেল মাত্রার বেশি শব্দের মধ্যে কাজ করতে হলে স্থায়ী বধিরতার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অথচ ইস্পাতশিল্প, জাহাজশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় নিয়জিত লাখ লাখ শ্রমিক এই স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে কাজ করে চলেছে। সর্বোপরি শব্দদূষণ বন্ধে শব্দসচেতনতা সৃষ্টি করতে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং শব্দদূষণ বিধিমালার বাস্তবায়ন করতে হবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর জন্য অতিরিক্ত শব্দ মানবস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতিকর দিকগুলো প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে জনসাধারণকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close