মো. মাসুদ হোসেন

  ০৮ মে, ২০২৪

মুক্তমত

নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কর্মহীনতা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রসার; সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষের হীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। শুধু ধর্ষণ করে ক্ষান্ত থাকছে না পাষ-রা, ধর্ষিত শিশুটিকে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করছে না। বাড়ির আঙিনায়, মাদরাসা, বাসে-লঞ্চে, পথে-ঘাটে-মাঠে বা স্কুলের চার দেয়ালে- শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চয়তা কোথাও নেই আজ। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলছে। এসবইয়ে জড়িয়ে আছে বড়দের স্বার্থ।

বিরামহীন ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে মানুষের নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের বিষয়টিই যে সামনে এসে পড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ যারা শিশু, ভবিষ্যতে তারাই হবে দেশ গড়ার কারিগর। একটি শিশু পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে স্নেহ, ভালোবাসা, আদর-সোহাগ, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আর সুন্দরের প্রত্যাশা নিয়ে। শিশুকে দেখলেই কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে সবার। সেই শিশুর জীবনই যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে গোটা সমাজই বিপদের সম্মুখীন হবে একসময়। তবে শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে কন্যাশিশুরা। প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজের কিছু নরপিশাচের ছোবলের শিকার হচ্ছে কোনো না কোনো মেয়ে। এর থেকে রক্ষা পায়নি কন্যাশিশুরাও। তারা পরিবার ও পরিবারের বাইরে বিভিন্ন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে অহরহ। পরিবারের কেউ না কেউ, আত্মীয়স্বজন কিংবা পাড়া প্রতিবেশীর দ্বারা যৌন হেনস্তা ও ধর্ষণ নয়, নৃশংস হত্যার শিকার হচ্ছে আমাদের কন্যাশিশুরা। অথচ তারা এসবের কিছুই বুঝেন না। বুঝে ওঠার আগেই দুনিয়ার কিছু হিংস্র মানবজাতির নৃশংস কর্মকাণ্ড কন্যাশিশুদের সুন্দর পৃথিবী দেখার স্বাদ এক নিমিষেই বিলীন করে দেয়।

সমাজের বিভিন্ন প্রতিশোধের বলি হচ্ছেন অনেক মা-বাবার আদরের অবুঝ শিশুকে। এসব ঘটনায় নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা কতটা বিচার পেয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। পত্রিকার পাতা উল্টালেই এর কিছু না কিছু আমরা দেখতে পাই। তবে বারবার ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো এটাই প্রমাণ করেছে, আমাদের বিচার-প্রক্রিয়া এবং আইনি তৎপরতার দুর্বলতার কারণে উপযুক্ত শাস্তি থেকে বেঁচে যায় অপরাধীরা। এই পার পেয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সমাজে আরো অনেককে একই ধরনের অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত করে। আগামীর শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে আগে পরিবারের সদস্যরা। তাদের স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে ঘরে থাকার সময় যত্নশীল হতে হবে। শিশুর সামান্য ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো ব্যক্তির কাছে যেতে না দেওয়াই ভালো। শিশুকে বাসায় একা রেখে কোথাও যাওয়া উচিত নয়। যথাসম্ভব মেয়েশিশুকে স্কুলে আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা থাকতে হবে ব্যাপক। সেই সঙ্গে ধর্ষণ রোধে মনিটরিং বা নজরদারি জোরদার করতে হবে আমাদের সমাজের সর্বস্তরের মানুষের।

পরিবারকে তাদের সন্তানের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার চর্চার অভাবে দেশে দিন দিন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধি হচ্ছে। মানুষের ভেতরে নৈতিকতাকে জাগ্রত করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ করতে হবে। পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। নৈতিকতার সঠিক চর্চা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে পারে। তবে কন্যাশিশুর পাশাপাশি ছেলেশিশুকেও ধর্ষণ ও যৌন হয়রানিবিরোধী মূল্যবোধ শেখাতে হবে। যেন বড় হয়ে ভবিষ্যতে সে এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকে। সবশেষে নারী ও শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে আমাদের।

ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতরা হয়ে পড়ছে অপ্রতিরোধ্য। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী থেকে বৃদ্ধা, স্কুলছাত্রী থেকে পোশাককর্মী, ডাক্তার, আইনজীবী এমনকি ভিখারিনীও রেহাই পাচ্ছে না মানুষরূপী এসব হায়েনার হিংস্র থাবা থেকে। ধর্ষিতাদের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ হচ্ছে, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন হচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। মিছিলে স্লোগান উঠছে, অপরাধীর ফাঁসি চাই। আলটিমেটাম দেওয়া হচ্ছে কখনো ৪৮ ঘণ্টার, কখনো আবার তিন দিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত। পরে অন্য ঘটনার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পুরোনো সব ঘটনা। ধর্ষণ রুখে দিতে প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, প্রতিটি পরিবারে যেমন কন্যাসন্তান আছে, তেমনি ধর্ষকরাও কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান। তাই ধর্ষণের মতো সামাজিক মরণব্যাধি নির্মূলে প্রতিটি পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে, পাশাপাশি মিডিয়ায় এ ধরনের ঘটনা প্রচারে আরো কৌশলী হতে হবে। সচেতনতার অভাবে বাড়ছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। এসব পরিবার সব সময় নানা ধরনের টানাপড়েনের মধ্যে থাকে। এর সুযোগ নেয় একধরনের নরপশু। তারা সুযোগ বুঝে এসব পরিবারের শিশুদের নিজের কাছে নেয় এবং অবুঝ শিশুরা তাদের লালসার শিকার হয়। সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে বেশির ভাগ নারী বিচার চাইতে যান না। আবার যেসব নারী বিচার চাইতে যান, তাদের পুলিশ, প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে যথেষ্ট হেনস্তা হতে হয়। ধর্ষণের অভিযোগগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রমাণ হয় না। এর মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে ঘটনার তদন্ত প্রভাবিত হওয়া।

লেখক : প্রবন্ধকার ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close