ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  ০৮ মে, ২০২৪

বিশ্লেষণ

জেলিফিশ প্যারেন্টিং ও বেপরোয়া কৈশোর

কিশোর গ্যাং বা উঠতি বয়সের ছেলেদের দলবদ্ধ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে আজকাল চিন্তার অন্ত নেই। এ চিন্তা পরিবার থেকে সমাজ ছাড়িয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র পর্যন্ত সবাইকে নাকাল করে তুলেছে। বহু কিশোর অবাধ্য ও বেপরোয়া হয়ে আমাদের সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনে অপারগতা প্রকাশ করতে শুরু করায় তাদের ‘বিগবস’দের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি ও লালনকৃত গ্যাং সমস্যা দিন দিন ভয়ানক হয়ে উঠছে। সাধারণত টিনএজার, যাদের বয়স শৈশব পেরিয়ে ১৩ থেকে ১৯ বছর, তাদের কিশোর বলা হয়ে থাকে। যদিও বিভিন্ন দেশে আবহাওয়া ও পরিবেশের প্রভাবে আন্তর্জাতিকভাবে আঠারো বছর পর্যন্ত বয়সকে শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের আইনত যোগ্য বয়স ১৮ এবং ছেলেদের জন্য ২১ বছর নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু কিশোরদের বয়সসীমা ‘টিনটিন’ বা তেরো-উনিশ পেরিয়ে যুবক বা অ্যাডাল্ট হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত একাধারে চলতেই থাকে। তাই আমাদের দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে যাদের বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার করে গণমাধ্যমে দেখানো হয়, তাদের অনেকের বাহ্যিক চেহারা দেখে বেশি বয়সের মনে হয়।

আমাদের দেশে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার নানা কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো অণুপরিবার ও পরিবারবিহীন জন্ম নেওয়া শিশু। দেশের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে অনেকের পরিবার নেই, আইনি অভিভাবক নেই। তারা জন্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ও ভাসমান শ্রেণির। আবার অনেক শিশু-কিশোরের পরিবার ও পারিবারিক আবহ বেশ উন্নত এবং জীবনযাত্রা অত্যন্ত আধুনিক। অনেকটা উন্নত বিশ্বের পারিবারিক পরিবেশের আদলে তারা বেড়ে ওঠে। এই শ্রেণির শিশু, কিশোর-কিশোরীরা ‘জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের’ বৈশিষ্ট্যে লালিত হয়ে জীবন শুরু করে।

‘জেলিফিশ প্যারেন্টিং’ হলো বাবা-মা অথবা অভিভাবকের মাধ্যমে সন্তানকে বড় করার একধরনের প্রচলিত ব্যবস্থা, যেখানে শিশুকাল থেকে অতি আদর-যত্নে শিশু-কিশোরদের লালনপালন করা হয়ে থাকে। জেলি মাছের যেমন শক্ত হাড় নেই, বাবা-মা তেমনই কোনো শক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেন না। এ ধরনের পরিবারে বাবা-মা তাদের শিশুদের কোনো কিছুর মধ্যে আবদ্ধ রাখেন না, তাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন না। শিশু-কিশোররা যখন যা চায় বা বায়না ধরে, তখনই সেটা পরিপূরণ করা হয়। বাবা-মা শিশুদের সঙ্গে কোনোরূপ বিবাদে জড়ান না।

এখানে বাবা-মা সন্তানের কাছে কোনো আদর্শ নন। সন্তানরা তাদের নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী অতি স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে। এমনকি বাবা-মা বকুনি দিলে সন্তান পুলিশকে ফোন করে মা-বাবার বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারে। এটি আধুনিক পশ্চিমা স্টাইল।

‘জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের’ বৈশিষ্ট্যে লালিত শহরাঞ্চলে বিত্তশালী পরিবারগুলোয় বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের অনেকেই বড় হতে গিয়ে বেঁকে যায়। তাদের বাইরের পৃথিবীর বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ঠিকমতো না হওয়ায় একটুতেই ঘাবড়ে যায়। আমাদের সমাজে মা-বাবা তাদের অতি যত্নে লালন করেন, গৃহশিক্ষক রেখে শিক্ষা দেন, দামি পোশাক, ভালো খাবার খেতে দেন। তবে ক্যারিয়ার গঠনে পশ্চিমাদের মতো উদার না হয়ে নানামুখী চাপ সৃষ্টি করেন। পরীক্ষায় এ-প্লাস ফলাফল তাদের চাই। অথবা নামকরা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার জন্য ভর্তি অথবা শিক্ষা শেষে ভালো চাকরি জোগাড় বা কিনে দেওয়ার ক্ষমতা ‘জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের’ বৈশিষ্ট্যধারী বিত্তশালী পরিবারগুলোয় বিরাজমান থাকে।

তবে একটু বড় হয়ে এসব শিশু-কিশোর তাদের মা-বাবার আসল চরিত্র খুঁজে পায় না। স্কুলে শিক্ষকদের কাছে শেখা নৈতিক জ্ঞানের নীতির অনুশীলন বাড়িতে এসে মা-বাবার মধ্যে দেখতে পায় না। এসব জানতে গেলে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের এড়িয়ে চলেন অথবা ভুল উত্তর দেন। এসব দেখে তারা সন্তানের প্রতি অবহেলা শুরু করেন। সন্তানরাও একসময় বিগড়ে যায়। যেহেতু তারা পরিবার থেকে কোনো পরামর্শ নেওয়ার দরকার মনে করেনি, সেহেতু হঠাৎ করে বাইরের পরিবেশে গেলে তারা উপযোজন লাভে ব্যর্থ হয়। আবার হঠাৎ কোনো খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেকেই দিশাহারা হয়ে পাঠে অমনোযোগী হয় এবং ‘এটারাক্সিয়ায়’ ভুগতে শুরু করে। অনেকে ঘর পালায়। আবার অনেকে নষ্ট বন্ধু বা সহপাঠীদের কাছ থেকে সিগারেট, মাদক ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনো কোনো কিশোরের সহপাঠী বা বন্ধুদের ১০ জনের মধ্যে সাতজনই ধূমপায়ী হলে একজন আর সাধু সেজে ভালো থাকার উপায় খুঁজে পায় না। একসময় সেও ওদের পাল্লায় পড়ে মাদক গ্রহণ করে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে মা-বাবার ওপর চাপ দেয়। না পেলে চুরি করে, মিথ্যা বলে অপরাধী হয় এবং ক্রমাগত বাড়তি টাকা জোগাতে ছিঁচকে অপরাধীদের জগতে প্রবেশ করে। সেখানে তারা বড় বড় গ্যাংয়ের কবলে নিপতিত হয়। ‘জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ে’ লালিত হওয়া কিশোরটি ভাসমান কিশোর অপরাধীগোষ্ঠীর সান্নিধ্যে চলে এলে মাফিয়াদের কল্যাণে সে একসময় সেই কিশোর গ্যাংয়ের নেতা মনোনীত হয়। সেখানে তার সমুদয় চাহিদা পরিপূরণের অবাধ সুযোগ দেখে হাতের কাছে অস্ত্র, মাদক, অর্থ- সবকিছু পেয়ে ভয়ংকর ‘গ্যাং লিডার’ বনে যায়।

দেশে দেশে কিশোর অপরাধীদের নিয়ে অনেক উপাখ্যান তৈরি হয়েছে, হয়েছে অনেক গবেষণানির্ভর প্রকাশনা। সেগুলোয় শিশুশ্রম, শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, ভিক্ষাবৃত্তি, শিশু পতিতাবৃত্তি, পানশালায় ওয়েটারগিরি, জমিদখল, চাঁদাবাজি, সর্বোপরি শিশুদের দিয়ে যুদ্ধের মারণাস্ত্র বহন প্রভৃতি উঠে এসেছে। আজকাল অবাধ ইন্টারনেটের সুবাদে থ্রিল, হিরোইজম, মাদক গ্রহণ, পর্নো ছবি প্রভৃতি দেখে ঘরে নিঃসঙ্গ থেকে অনেক শিশু-কিশোর পাকামি শিখে ফেলছে। এআই ব্যবহারের সুবাদে সাইবার ক্রাইম নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। রাজধানীর বস্তিতে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোর রয়েছে ১২ থেকে ১৩ লাখ। এদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক রয়েছে ‘জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ে’ লালিত হওয়া বিত্তশালী ঘরের বখাটে কিশোররা। তারা অকুতোভয়ে লিড দেয়। তাই আমাদের দেশে কিশোর গ্যাং সমস্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাদের নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে সংশ্লিষ্ট পরিবার ও অভিভাবকদের মধ্যে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাং সমস্যা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা নাজেহাল হয়ে পড়ছে।

অন্যদিকে ‘জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের’ বৈশিষ্ট্য পরিবার থেকে স্কুলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের শাসন করার সিস্টেম উঠে গেছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ার গ্রুপ এখন নষ্ট রাজনীতির কবলে রাহুগ্রস্ত। এমনকি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরাও একই দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ছেন। ফলে পাঠদান বাদ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং, টিজিং, যৌন নিপীড়ন প্রভৃতি নানা কুকর্ম ফুলে-ফেঁপে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন নামিদামি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে।

সে জন্য পরিবার থেকেই সমাধান খুঁজতে হবে। ‘জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের’ বৈশিষ্ট্যের পরিবারগুলোকে সাবধান হতে হবে। বাংলাদেশের কৃষ্টিতে বসবাস করে পশ্চিমা কৃষ্টির লালন ও চর্চা আমাদের জন্য সাংঘর্ষিক। এ প্রক্রিয়া দিন দিন সামাজিক দূরত্ব বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ‘জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের’ আবহে টিচিং ও লার্নিং সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখা দিচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর সঙ্গে বসে দামি ওয়াইন খায়। সেটা তাদের কৃষ্টির চলমান ধারা। আমাদের দেশজ সংস্কৃতি লালন করে বেঁচে থাকার সঠিক উপায় খুঁজে নিতে হবে। তা না করায় পান থেকে একটু চুন খসার মতো ছোট সমস্যা হলেই নানা কারণে সেটাকে আরো বেশি জটিল থেকে জটিলতর করে তোলা হচ্ছে। বিশেষ রাজনৈতিক চাপ ও আবহের মধ্যে দায়িত্বে থেকে পুলিশের পক্ষে এ ধরনের সামাজিক সমস্যা নিরসন করা অসম্ভব; যা আমাদের আর্থসামাজিক ও পারিপার্শ্বিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার শঙ্কা সৃষ্টি করছে।

শিশুকে হাঁটতে শেখান, হাঁটা শিখলে নিজে নিজে চলতে দিন। কোথাও পড়ে গেলে সে যেন নিজেই উঠে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করে আবার গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে উঠে হাঁটতে পারে- সেই অনুপ্রেরণা দিন। বাংলাদেশে একদিকে অতি আদর, অন্যদিকে অতি দারিদ্র্য ওদের দিশাহারা করে অবৈধ পথ বেছে নিতে বাধ্য করছে; যা ইতিমধ্যে কিশোর গ্যাং নামে অতি মারমুখী চরিত্র ধারণ করে সমাজে বিষবাষ্প ছড়ানো শুরু করেছে। আপনার-আমার উঠতি ছেলেমেয়েরা যেন ভুলপথে পা না বাড়ায়, সে জন্য প্রতিটি পরিবারকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

‘জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের’ আবহে ‘জেলিফিশ টিচিং, লার্নিং ও সার্ভিসিং’ কোনোটাই আমাদের সমাজের পরিবেশ উপযোগী হতে পারে না। আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও স্বকীয়তা থেকে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে একটি ‘ট্রান্সফরমেটিভ চেঞ্জ’ এবং ‘লিভিং উইথ হারমোনি’র মাধ্যমে সবাইকে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন বেছে নিতে হবে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ সবকিছু পরিহার করতে হবে। নিজের জীবনের রূপকার নিজেকেই হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সেটা দ্রুত করতে না পারলে সমাজ আরো বেশি অস্থির হয়ে পড়বে এবং অবাধ্য ও বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের মতো সংক্রামক সমস্যা জনমনে ভয়ংকর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হবে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close