নুরুল্লাহ কামিল, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম

  ০১ মে, ২০২৪

কক্সবাজার ভ্রমণ ‘ছুঁয়ে এলাম সমুদ্র জল’

অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি ত্বহা বাবু আর তুবা মনি মহা-উৎসাহে টিভি দেখছে। পিঠাপিঠি ভাই-বোন ওরা। ত্বহাবাবুর বয়স এবার পাঁচ বছরে পড়েছে, নীলফামারীতে আমাদের কর্মস্থলের পাশে একটি স্কুলে ভর্তি করেছি ওকে। ত্বহা শুধু প্রশ্ন করে, প্রচুর কৌতূহল সব বিষয়ে। আর তুবা মনির বয়স হলো একুশ মাস। অস্পষ্ট কিছু শব্দ সেও উচ্চারণ করতে পারে।

ডিসকভারি চ্যানেলে তখন উন্মুক্ত সমুদ্রের মধ্যে সাঁতার কাটছিল কয়েকটা ডলফিন। পরের দৃশ্যের সচ্ছ পানির ঢেউ সমুদ্রের পাড়ে এসে আছড়ে পড়তে দেখে ত্বহা বাবু বলে উঠল বাবা সত্যিকারের সমুদ্র কেমন হয়? আমি বললাম সমুদ্র এমনই হয় বাবা। তুমি দেখবে? ওর মা কথার প্রায় মাঝখানেই বলে উঠল চলো এবার সমুদ্রের পাড়ে ঈদ করি আমরা। কি ত্বহা বাবু! বাবাকে বলো এবার ঈদের ছুটিতে আমাদের কক্সবাজার নিয়ে যেতে! তাহলেই তো তুমি সত্যিকারের সমুদ্র দেখতে পাবে। কথাটা অবশ্য মন্দ বলোনি, এবার ঈদে তাহলে কক্সবাজারই ঘুরে আসা যাক বেশ জোরেশোরেই বলে উঠলাম আমি। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। চাকরি জীবন যেমন হয় আর কি, অফিস থেকে বাসা আর বাসা থেকে অফিস। একদম গৎবাঁধা সবকিছু। ভাবলাম এর মধ্যে একটু ঘোরাঘুরির সুযোগ পেলে সেটা আমাদের নেওয়াই উচিত। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে সুন্দর কিছু সময় তো উপভোগ করা যাবে অন্তত! সব মিলিয়ে তখনই সিদ্ধান্ত হলো ঈদ এবার কক্সবাজার করব আমরা।

আমার ছোট মামাতো বোনটা কক্সবাজার জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স। কল দিলাম বোন জামাইকে, উনি তো মহাখুশি।

বললেন বড়ভাই আমরা বেশ কবছর ধরে এখানে আত্মীয়স্বজন ছাড়াই ঈদ করি। আপনারা এলে তো খুবই ভালো লাগবে। বোনকে বললাম আসছি তাহলে এবার সামুদ্রিক মাছ আর শুঁটকি কিনে রেডি থাকো তোমরা!

নীলফামারী থেকে কক্সবাজার অনেক দূরের পথ। তা ছাড়া রোজা রেখে ছোট্ট বাবুদের নিয়ে বাস বা ট্রেনে ভ্রমণ কষ্টদায়ক হবে। তার ওপর আবার ঈদের সময় টিকিট পাওয়ার ঝক্কিঝামেলা বেশি। তাই উড়ো জাহাজে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছিলাম। পরের দিন খোঁজ নিয়ে জানলাম, সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে কক্সবাজার সরাসরি সপ্তাহে দুটি করে ফ্লাইট আছে। দেরি না করে বুকিং করে ফেললাম আমাদের যাওয়া-আসার টিকিট।

নির্ধারিত দিনে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখি আমাদের ফ্লাইট পিছিয়েছে ঘণ্টাখানেক। কী আর করা, বসে থেকে রানওয়েতে উড়ো জাহাজের ওঠানামা দেখে আর বাবুদের সথেঙ্গ নিয়ে পায়চারি করতে থাকলাম। অবশেষে এলো আমাদের সময়। সৈয়দপুরের রানওয়ে যখন আমরা ছাড়লাম তখন বেলা সাড়ে বারোটা। নীল আকাশ আর সাদা মেঘের মধ্য দিয়ে ঘণ্টা দেড়েক ওড়ার পরে নিচে হঠাৎই সমুদ্রের দেখা মিলল। সথেঙ্গ এয়ার হোস্টেজের সুমিষ্ট কণ্ঠ, আমরা কক্সবাজার বিমানবন্দরে নামতে চলেছি এই বার্তা।

আমরা তাহলে চলেই এলাম কক্সবাজার! বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে একদম সোজা বোনের বাসায়। তখন সময় দুপুর আড়াইটার মতো। ত্বহা বিমান থেকে নামা অব্দি নাহলেও দশবার বলেছে, বাবা সমুদ্র কই, বাবা বাবা... সমুদ্রে চলো...!

বাসায় পৌঁছার পর ওরা দুজন আমার বোনের একমাত্র মেয়ে তাসনিয়ার সঙ্গে খেলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বোনকে বুঝিয়ে বললাম যে আমরা একটা হোটেলে উঠব। কারণ বাসায় থেকে ভ্রমণের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যাবে না। অনেক কষ্টে বোনকে রাজি করানো গেল। বোনজামাই শহিদুল ভাইসহ গেলাম হোটেল খুঁজতে। শেষমেশ আমরা রুম পেলাম লাবণী আর সুগন্ধা পয়েন্টের মাঝামাঝি একদম রাস্তার পাশের একটি হোটেলে। লাগেজপত্র নিয়ে রুমে ওঠার পর সবাই মিলে সুগন্ধা পয়েন্টে গেলাম সমুদ্র দেখতে। একে তো রোজার মাস তার ওপরে আবহাওয়া গরম, শরীর বেশ ক্লান্ত লাগছিল। তবে বিচের কাছাকাছি এসে বেশ ভালোই লাগল। রোজার জন্যই হয়তো সমুদ্র পাড়ে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় নেই এখন।

কি বিপুল জলরাশি! ছোট-বড় ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ছে পরিষ্কার ভেজা বালুর ওপর। ত্বহা প্রথমবার সমুদ্র দেখে বেশ অবাক হয়েছে। আর তুবা মনি ভয় পাচ্ছে কিছুটা। তবে ওদের মায়ের চোখেমুখে বেশ উচ্ছ্বাস দেখলাম। সব মিলিয়ে প্রথমবার সমুদ্র দেখাটা বেশ উপভোগ করেছিলাম আমরা।

আসল ঘোরাঘুরি শুরু হয়েছিল মূলত ঈদের দিন থেকে। ঈদের নামাজ পড়লাম কক্সবাজার স্টেডিয়ামের সামনের প্রধান ঈদগাহে। তারপর হোটেল থেকে বোনের বাসায় গিয়ে সবাই মিলে মিষ্টিমুখ করার পর সিদ্ধান্ত হলো মহেশখালী দ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার।

স্পিডবোট যখন আমাদের মহেশখালী নামিয়ে দিল তখন সরু প্যাসেজের মতো লম্বা জেটিটা চোখে পড়ল। আশপাশে কেউড়া, গোল পাতার মতো ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। এটা কি সুন্দরবন নাকি? বলে উঠলাম আমি, বোনজামাইটা বলল না ভাই তবে কিছুটা সুন্দর বনের ফিল নিয়ে নেন, এক ভ্রমণে দুই ফ্লেভার আরকি। মুচকি হেসে সামনের দিকে পা বাড়ালাম আমরা। মহেশখালীতে শুঁটকি আর লবণের ঘের দেখলাম। ঝাউবন, আর বেশ কিছু মন্দিরও দেখেছিলাম আমরা। বিকেলের দিকে বোনের বাসায় ফিরে আরেকপ্রস্থ খাওয়া-দাওয়া হলো। রূপচাঁদা মাছ, চিংড়ি মাছ, শুঁটকি ভর্তা আরো দু-এক রকম তরকারি করেছে আমার বোন। খেতে খেতে পরদিন কোথায় যাওয়া যায় সে বিষয়ে আলাপও করা হলো। বোনজামাই বলল, হিম ছড়ি মেরিন ড্রাইভ এবং ইনানি বিচ ঘুরতে হবে, ওইদিকটায় মিনি বান্দরবন, রেজুখাল আর এদিকে ফিশওয়ার্ল্ড এই কয়টা জিনিস আপনাদের দেখতেই হবে বড় ভাই। আমি বললাম, তাহলে কালকে চলেন হিমছড়ির ঝরনা দেখে আসি।

মাছটা তো বেশ স্বাদ হয়েছে সালমা, তা আর কী কী মাছ খেয়েছো তোমরা এখানকার? আরো অনেক মাছ আছে ভাই তোমরা আরো কটা দিন থাকো তাহলে একে একে সব মাছ খেয়ে যেতে পারবে। এই কদিনের সাহরি-ইফতার সব আমার বোন পাঠিয়েছে, অর্থাৎ আমরা থেকেছি হোটেলে কিন্তু প্রতি বেলার খাবারই পাঠিয়েছে ওরা। বোনগুলো এমনই হয় হয়তো।

সেদিন সন্ধ্যায় সুগন্ধা পয়েন্টের রাস্তায় আমরা মাছ ভাজা খেতে গেলাম। এখানে ছোট ছোট ভ্যানে করে কাঁকড়া, অক্টোপাস, লবস্টার, চিংড়ি ফ্রাই, বারবিকিউ করে বিক্রি হয় রাস্তার পাশে। কাঁকড়া, স্কুইড, লবস্টার আর কয়েকটা মাছ খেয়েছি আমি। ত্বহা বাবু আর তুবামনি কাঁকড়া খেয়েছে তবে ওদের মা শুধু স্কুইডের ফ্রাই খেয়েছে দু-একটা। কাঁকড়া দেখে নাকি ওর ভয় ভয় লাগে!

ঈদের পরের দিন সকালে আমরা বের হলাম হিম ছড়ি পাহাড় আর ঝরনা দেখতে। অটোতে করে যখন মেরিন ড্রাইভ রোডে ঢুকলাম তখন মনে হলো এটাই বোধ হয় কক্সবাজারের সবচেয়ে সুন্দরতম স্থান। রাস্তার একপাশে সমুদ্র অন্যপাশে পাহাড়। কিছু কিছু স্থানে তো সমুদ্র একদম রাস্তার কাছাকাছি। বালুর ওপরে রাখা সাম্পান, জলের ঢেউ, বাতাস, ঝাউগাছ, পাহাড় আর গাছ পালার ঝোপঝাড় মিলিয়ে অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভার মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছালাম রেজুখাল সংলগ্ন কক্সবাজারের মিনি বান্দরবানে। আমরা পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। ত্বহা বাবু ওপরে উঠে ভালোই মজা পেয়েছে বলে মনে হলো। একটু পরপর বলছে বাবা পাহাল পাহাল, ও মাঝে মাঝে ‘র’র উচ্চারণ করতে পারে না। তাই পাহাড়কে পাহাল শোনাচ্ছিল। আমরা কিছুক্ষণ বসে ছবি তুলে চলে এলাম হিম ছড়ি। টিকিট কেটে ঢুকে হাতের ডান পাশে পড়বে ঝরনা। বেশ কিছু লোকসমাগম হয়েছে দেখলাম। সব সময়েই নাকি এমন পর্যটক থাকেন এখানে। ঝরনা খুব বেশি একটা বড় না, তবে দেখতে সুন্দর আছে। ঝরনার পানি হাতে নিয়ে তুবামনির গালে ছিটিয়ে মজা করলাম কিছুক্ষণ।

এবার পাহাড়ে ওঠার পালা, সবাই পাহাড়ের গায়ে লম্বভাবে দেওয়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে যখন আমরা পাহাড় চূড়ায় পৌঁছালাম, তখন প্রায় বিকেল। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। ওপর থেকে সমুদ্রের জলে সূর্যের আলোর অপূর্ব খেলা দেখলাম আমরা। সবাই বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিল। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিচে নেমে পড়লাম। পরের দিন সকালে আমাদের ফিরতি ফ্লাইট। রাতে তাই শেষবারের মতো সমুদ্র দেখতে গেলাম আমরা। সমুদ্র সৈকতে ত্বহা বাবুকে নিয়ে ঘোড়ায় উঠলাম আর ও ঘুড়ি চাইলে ঘুড়ি কিনে দেওয়া হলো। শেষ দিন তাই সৈকতে বালু দিয়ে রাজপ্রাসাদ বানানোর অনুমতিও মিলল আরেকবার। পরের দিন দুপুর বারোটা নাগাদ বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা পোঁছালাম কক্সবাজার বিমানবন্দরে। এবার অবশ্য যথাসময়েই এলো আমাদের বিমান। ওঠার আগে এই কদিনে দেখা স্মৃতিগুলো অকপটে আরেকবার চোখের সামনে ভেসে উঠল আমার। কালকে থেকেই আবার নিয়মিত জীবন শুরু তবে এই ভ্রমণের স্মৃতি আমাদের থেকে যাবে আজীবন। এসব ভাবতে ভাবতে সৈয়দপুরের উদ্দেশে উড়ে চললাম আমরা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close