মুহাম্মদ সুলতান মাহমুদ, ঢাকা কলেজ
সেন্টমার্টিনে মনোবিজ্ঞান বিভাগ
উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো ঢাকা কলেজ, যা ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা কলেজে ২০টি বিভাগ রয়েছে। তার মধ্যে মনোবিজ্ঞান বিভাগ অন্যতম। আমাদের ব্যাচের শিক্ষা সফরের জন্য অনেক দিন ধরেই পরিকল্পনা চলছিল কিন্তু কিছু সংগত কারণে বিভাগ থেকে অনুমোদন পায়নি বলে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
অনার্স জীবনে একটি ডিপার্টমেন্টের ট্যুর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেটি আমরা দেখেছি অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের অথবা আমাদের সিনিয়রদের বেলায়। তাই আমরা কেউ চাইনি অনার্স জীবনটা ট্যুরবিহীন কেটে যাক। আমাদের ২০১৯-২০ সেশনের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয় জানুয়ারি ২০২৪ সালে। তাই এখনই উত্তম সময় ৪র্থ বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই আমাদের ট্যুরের ব্যবস্থা করা। কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের ব্যাচের সিআরসহ আরো কয়েকজন কর্মঠ বন্ধু এবং সহপাঠীরা মিলে পরিকল্পনা করে প্রস্তাব দিল ৪ রাত ৩ দিনের সেন্টমার্টিন ট্যুরের।
যেহেতু বেশ লম্বা সময়ের ট্যুর এবং তখন বাংলাদেশের সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা চলছিল, যার ফলে টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল সাময়িক বন্ধ ছিল এবং আমাদের বিভাগের অনেক বন্ধু এবং সহপাঠীদের বাসা থেকে তাদের যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। তাই সব মিলিয়ে ১১০ জনের শিক্ষার্থীর একটা ব্যাচের মধ্যে ৪০ জন যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল। পুরো ট্যুরকে পরিচালনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হলো। এই ট্যুরকে স্মরণীয় করার জন্য কাস্টমাইজড টি-শার্ট এবং চাবির রিং বানানো হলো। আমরা হলাম আমাদের বিভাগের ২২তম ব্যাচ। এই ট্যুরকে কেন্দ্র করে বিশেষভাবে আমাদের ব্যাচের নাম দেওয়া হলো ‘সাইকোটিক-২২’।
মার্চ মাসের ২ তারিখ রাত ৮টায় আমরা সবাই কলেজের ক্যাম্পাসে চলে এলাম, তারপর কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে টি-শার্ট এবং চাবির রিং সংগ্রহ করলাম। তারপর আমাদের বিভাগের প্রধান প্রফেসর আবু সৈয়দ মো. আজিজুল ইসলাম আমাদের ট্যুর নিয়ে কিছু পরামর্শ দিলেন। পরামর্শ শেষ হওয়ার পর সবাই গ্রুপ ছবি তুললাম স্যারের সঙ্গে। এরপর রাত ১০টায় আমাদের বাস ছেড়ে দিল কক্সবাজারের উদ্দেশে। আমরা সবাই বাসের মধ্যে আনন্দ নিয়ে মিছিল করতে করতে যাচ্ছিলাম। আমাদের এই ৪০ শিক্ষার্থীর প্রত্যেকের চিন্তা, মনোভাব, উদ্দেশ্য আলাদা কিন্তু ওই সময় বাসে কমবেশি সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম, তখন তাদের চেহারায় আনন্দের ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম শুধুত্র এই ট্যুরকে কেন্দ্র করে।
বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগই আমরা ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন আমরা কক্সবাজারে। আমাদের ইনানি বিচে যেতে হবে, সেখান থেকেই জাহাজ ছাড়বে সকাল ১০টায়। এখানে মজার ব্যাপার হলো, আমাদের বাস ড্রাইভার পথ ভুল করে কক্সবাজারের উখিয়ার দিকে চলে গিয়েছিলেন। যেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প অবস্থিত। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সেখানে কিছুক্ষণের জন্য বাস থামিয়ে সেখানকার স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করে সঠিক পথে চলে এসেছিলাম। এই ছোট ভুলের উছিলায় আমাদের খুব কাছ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প দেখা হয়ে গিয়েছিল।
মেরিন ড্রাইভ ধরে আমাদের বাস চলছিল এবং ৯টায় আমরা ইনানি জেটি ঘাটে চলে এলাম। সেখানে সবাই সকালের নাশতা করলাম, তারপর টিকিট সংগ্রহ করে অসম্ভব সুন্দর জেটি ঘাট দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। তারপর উঠে পড়লাম আমাদের এমভি বারো আউলিয়া জাহাজে। প্রথমবার সমুদ্র দেখা জাহাজে ওঠা এ যেন অসম্ভব সুন্দর একটা অনুভূতি। আমরা সবাই জাহাজের একটি সাইডে বসেছিলাম। জাহাজ সময়মতো ছেড়ে দিল। আমরা তখন সমুদ্র ভ্রমণ উপভোগ করতে শুরু করলাম। অন্যদের মধ্যে কেউ আড্ডা দিচ্ছিল, কেউ ছবি তুলছিল, কেউ গান করছিল, কেউ ঘুমাচ্ছিল। সব মিলিয়ে আনন্দ করতে করতে সাড়ে চার ঘণ্টার পথ পারি দিয়ে দুপুর ২:৩০টায় আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই জায়গা সেন্ট মার্টিন চলে এলাম।
জাহাজ থেকে নেমে বিচ দিয়ে হেঁটে আমাদের বুকড করা রিসোর্টে চলে গেলাম। সেন্টমার্টিন সাধারণত ৫টি ভাগে বিভক্ত, উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, মাঝেরপাড়া, পূর্ব ও পশ্চিমপাড়া। আমাদের রিসোর্সটি ছিল উত্তরপাড়া বিচের একদম পাশেই। যার রুম থেকেই সমুদ্র দেখা যায়। আমরা চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত দুপুরের খাবারের জন্য হোটেলে চলে এলাম। এখানে সামুদ্রিক মাছের বৈচিত্র্যের যেন শেষ নেই। আমরা প্রত্যেকেই ভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়েছিলাম। খাবারের সময় ঘটল বেশ মজাদার অদ্ভুত কান্ড। আমরা সবাই এত বেশি ক্ষুধার্ত ছিলাম যে হোটেলের সব ভাত শেষ করে ফেলেছিলাম। একটা পর্যায়ে ভাত চাইলে হোটেলের স্টাফ এসে বলল ভাই আমাদের ভাত শেষ। যাই হোক খাবার শেষ করে আমরা রিসোর্টে চলে এলাম। অল্প কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সমুদ্রে। এ যেন এক শান্তির অনুভূতি, নামার সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যেন নিমিষেই হারিয়ে গেলাম।
পরদিন আমাদের ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ছেঁড়া দ্বীপে কয়েকভাবে যাওয়া যায়। হেঁটে, সাইকেল অথবা মোটরসাইকেল ভাড়া করে কিংবা ট্রলারে করে। আমরা আমাদের ছেঁড়া দ্বীপের এই যাত্রাকে আরো বেশি এক্সাইটমেন্ট করার জন্য ট্রলার ভাড়া করলাম। সবাই জেটি ঘাট থেকে ট্রলারে উঠলাম। এইটিই বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের একটা অংশ এরপর আর কোনো ভূখন্ড নেই। প্রচন্ড সূর্যের তাপ ছিল, যা থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য অনেকে মুখে সান স্কিন ক্রিম দিল। আর আমরা অনেকে গামছা আর ক্যাপ নিয়ে গিয়েছিলাম। অনেকের সি সিকনেসের জন্য পানি, স্যালাইন নিয়ে গিয়েছিল। সাধারণত ট্রলার ছেঁড়া দ্বীপের কাছে নোঙর করতে পারে না পানি কম থাকার কারণে। যার ফলে আমাদের সেই ট্রলার থেকে অন্য ছোট একটি নৌকায় করে দ্বীপে যেতে হয়েছে। সেখানে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা আবার একইভাবে সেন্টমার্টিন ফিরে এলাম।
এই দিন রাতে হলো আমদের জম্পেস আড্ডা। কোরাল মাছের বারবিকিউর আয়োজন করা হলো। রাতের খাবার খাওয়ার পর বিচের পাশে আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বসে গানের আসর বসাল। অনেকে গানের তালে তালে নাচানাচির শুরু করল। যতক্ষণ আগুন জ্বলছিল ততক্ষণ গানের আড্ডা চলেছিল। রাত যত গভীর হচ্ছিল সমুদ্রের গর্জন তত বেশি অনুভব করা যাচ্ছিল। এটি এক প্রকার মেডিটেশনের কাজ করে। রাতের সে সময় যখন ওপরে তাকাই দেখি পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারকার খেলা। চারপাশ অন্ধকার আমি দাঁড়িয়ে আছি ৮ বর্গকিলোমিটারের একটা দ্বীপে। যেটির চারদিকে অসংখ্য জলরাশি আমাদের ঘিরে আছে। আমাদের দুটি রাত অনেকটা চলে গিয়েছিল এই দৃশ্যগুলো উপভোগ করেই।
পরদিন ৫ তারিখ বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই দেখলাম পরিবারের জন্য সেন্টমার্টিনের বিখ্যাত শুঁটকি, বিভিন্ন ধরনের আচার, বাদাম, ঝিনুকের মালা ইত্যাদি কিনল। বেলা ১১টায় রিসোর্ট থেকে আমরা চেক আউট করে বের হয়ে গেলাম তারপর বিচে বেশ কিছু সময় আড্ডা দিলাম এবং সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুললাম। সূর্য যখন মাথার ওপরে তখন আমরা দুপুরের খাবারের জন্য হোটেলে চলে গেলাম। খাবার শেষ করে সবাই দ্রুত জাহাজে উঠে পড়লাম। জাহাজ ছেড়েছিল বিকেল ৪টায়। সেই সময়টিতে সবারই একটু মন খারাপ ছিল। কারণ সুন্দর মুহূর্তগুলো আমরা খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। সব মিলিয়ে দুই দিন থাকার পরে ও আমরা অনেক কিছু এক্সপ্লোর করতে পারিনি। এ এমন একটা স্থান, যেখানে বারবার আসতে মন চাইবে।
সেদিন সমুদ্র ছিল অনেক শান্ত। রাতের সমুদ্র ভ্রমণ সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস সেটি যে কারো মন ভালো করে দিতে বাধ্য। সাড়ে চার ঘণ্টা জাহাজ ভ্রমণ শেষ করে রাত সাড়ে ৮টায় আমরা ইনানি জেটি ঘাটে পৌঁছে গেলাম। তারপর আমাদের রিজার্ভ বাসে করে কক্সবাজার লাবণী পয়েন্ট চলে এলাম। তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। সেখানে রাতের খাবারের আয়োজন করা হলো। খাবার পরিবেশনের আগ পযন্ত যতটুকু সময় পেয়েছিলাম ওই সময়টি আমরা লাবণী বিচে কাটালাম। তারপর রাতে খেয়ে বাসে উঠে পড়লাম।
এবার বাড়ি ফেরার পালা। সবাই খুব ক্লান্ত, তাই ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসার মুহূর্তে সবাইকে যতটা এনার্জেটিক লেগেছিল। এখন কক্সবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার মুহূর্তে তার পুরো বিপরীত বাসে উঠেই সবাই ঘুম। আমাদের বাস তার আপন গতিতে চলতে লাগল। সকাল হওয়ার পর কুমিল্লায় একটা হোটেলে কিছুক্ষণ বিরতি দিল। বিরতি শেষ করে বাসে উঠে পড়লাম, তারপর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সবাই নিরাপদে ঢাকা প্রবেশ করলাম। আর এভাবেই আমাদের সুন্দর ট্যুরটির সমাপ্ত হয়েছিল। আগামী বছরের শুরুর দিকেই আমাদের ব্যাচের সবার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবে। তারপর সবাই যার যার লাইফ, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। হয়তো আর কখনোই একসঙ্গে এত সুন্দর ট্যুরের ব্যাবস্থা করে পাগলাটে উদযাপন করা হবে কি না জানি না। মিস করব সাইকোটিক টোয়েন্টি-টু কে।
"