নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১০ জানুয়ারি, ২০২৪

আশা দেখাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা

শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে গতি পাবে অর্থনীতি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছিল নানা সংকট। ডলার সংকট, হরতাল-অবরোধের কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতি এমনকি বিদেশি বিনিয়োগও তুলনামূলক কম। তবে আশার বাণী শোনাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ায় জনমনে স্বস্তি বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকায় অচীরেই অর্থনীতিতেও স্বস্তি আসবে। এরই মধ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহে গতি বেড়েছে। রপ্তানি আয়ে এখন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও ঠেকানো গেছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত আশা করছেন, অচিরেই অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন না। এখন একটি সুষ্ঠু ভোট হয়ে গেল। ফলে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। এতে করে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে মনোযোগ দেবেন। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা নিজ থেকেই বিনিয়োগ করতে শুরু করবেন।

ড. জায়েদ বখত আরো বলেন, আমি মনে করি এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের আত্মবিশ্বাস এসেছে। মানুষ বিশ্বাস করছে, সরকার প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পেরেছে, সেহেতু অর্থনীতি অচিরেই ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, বিদেশিদের নিয়ে নির্বাচনের আগে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা হলেও এখন মনে হচ্ছে বিদেশিরা এই নির্বাচন দেখে খুশি হয়েছে। দেশের মানুষ এই সরকারকে পেয়ে খুশি হলে বিদেশিরা আর নাক গলাতে আসবে না। আর এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে কোনো বিরূপ মন্তব্য আসেনি।

জায়েদ বখত বলেন, মূলত নির্বাচনকে নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা ছিল, সেটি কেটে গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, এখন পর্যন্ত অর্থনীতির মৌলিক কোনো খাতে বিপর্যয় নামেনি। মানুষের মধ্যে যখন আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে, সরকার যখন সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ণ করবে তখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। নির্বাচনকে সামনে রেখে অপ্রিয় কিছু নীতি সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন যেহেতু একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, এখন অর্থনীতির স্বার্থে ডলারের রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার মতো আরো অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতে এখন মূল্যস্ফীতি তাৎক্ষণিক কিছুটা বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। এছাড়া সরকার নতুন করে জনগণের সমর্থন পাওয়ার পর রাজস্ব আহরণে মনোযোগ দেবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারলে এর ইতিবাচক ফল আসবে। তিনি বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। হয়তো সরকার এবার অর্থনীতির সংস্কারের দিকেই মনোযোগ দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, নির্বাচনের পর ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, প্রতিবার ইলেকশনের আগে এ রকম হয়। আমরা দেখি একটা অনিশ্চয়তা থাকে। ইলেকশনের পর যখন নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, আপনারা দেখবেন যে খুব দ্রুত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, অনেক অনিশ্চয়তার এই নির্বাচনটি ভালোভাবে হওয়ার কারণে সমাজে এক ধরনের স্বস্তি ফিরেছে। যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল, তাতে অনেকেই আশঙ্কা করেছিল, এই অনিশ্চয়তায় নির্বাচন না হলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। আমরা সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। তবে চ্যালেঞ্জ এখনো আছে। কারণ অর্থনীতি গতিশীল করতে নতুন করে সংস্কার করতে হবে। আর অর্থনীতিতে যে সংস্কার শুরু হয়েছে, সেগুলো জোরদার করতে হবে। খুশির খবর হলো অলরেডি আমরা সংস্কারের মধ্যেই আছি।

তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে আর্ন্তজাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের সংস্কারের মধ্যেই আছি। নতুন সরকার এই সংস্কার কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে করতে পারবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি প্রণয়ন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফিসক্যাল পলিসি তথা রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন খরচ কমানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবশ্য ডলারের সঙ্গে বিনিময় হারের এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে। এটা ঠিক করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। শুল্ক হার কমাতে হবে। মূল্যস্ফীতির কষাঘাতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের সাপোর্ট দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতে হবে।

এদিকে অর্থনীতির তথ্য উপাত্ত বলছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যাওয়া এই রিজার্ভ এখন ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে উন্নীত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সদ্য বিদায়ি ডিসেম্বর মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৭.০৬ শতাংশ বেড়েছে।

এদিকে জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা এবং সম্ভাবনা ২০২৪’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ নামতে পারে। অবশ্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। সদ্য বিদায়ি ২০২৩ সালে এ দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। নতুন বছর তা বেশ খানিকটা কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে নামবে। ২০২৫ সালে সেটি আরো কমে সাড়ে ৫ শতাংশ হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের ৫০ শতাংশের মতো বাড়ানোর পর মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যায়। ২০২৩ সালজুড়েও মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভব করেছেন সাধারণ মানুষ।

এদিকে ইপিবির তথ্য অনুযায়ী সদ্য বিদায়ি ডিসেম্বর মাসে দেশের পণ্য রপ্তানি কমেছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের ডিসেম্বরে রপ্তানি আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ০৬ শতাংশ। এ নিয়ে টানা তিন মাস কমেছে দেশের রপ্তানি আয়। অবশ্য চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় ১ দশমিক ৭২ শতাংশ বেড়েছে।

প্রসঙ্গত, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ২২২ আসনে জয়ী হয়েছে দলটি। এছাড়া জাতীয় পার্টি ১১টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close