ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

  ০৫ মে, ২০২৪

মতামত

ছাত্ররাজনীতি পরিশুদ্ধি হতে পারে নিষিদ্ধ নয়

যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে যারা রাজনীতি করে তারাই প্রকৃত রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠে।’ বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে’ (বুয়েট) একটি অপরাধকে কেন্দ্র করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ। পোকা ধরা ফলের জন্য কী গাছটাই কেটে ফেলতে হবে? বরং ছাত্ররাজনীতি না থাকার কারণে বুয়েট এখন মৌলবাদের আঁতুড় ঘরে পরিণত হয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের ঘটনা আপনাদের মনে আছে? বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হয়েছে সত্য। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ছাত্ররাজনীতির পরিশুদ্ধি হতে পারে, নিষিদ্ধ নয়।

বুয়েটে ভর্তি হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবীদের একাংশ। বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একাংশ যদি এ দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকে, তাহলে বুয়েট যে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাবে এটা সবার জানা। বাংলাদেশ কী বঞ্চিত হবে না? টাঙ্গুয়ার হাওরে দেশবিরোধী, সংবিধানবিরোধী চক্রের মিটিং; জাতির জন্য শঙ্কিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। বুয়েটে রাজনীতি করা যাবে না; এমন কিছু বাংলাদেশের সংবিধানে নেই। বুয়েটে যদি ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হয় তা সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী।

হ্যাঁ, আমরা মানছি ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি আগের মতো নেই। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশও চায় না বুয়েটে রাজনীতি আবার চালু হোক। এর কারণ ভয়। আবরারের পরিণতির ভয়। এমন ঘটনা তো সব সময় ঘটে না। যারা এই অপরাধ করেছিল তারা ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সেটি মারাত্মক অপরাধ ছিল। কিন্তু এক অপরাধের জন্য আমরা দিনের পর দিন অসংখ্য অপরাধ করে যেতে পারি না। ভালো করে খোঁজ নিয়েই বলছি, বুয়েট ক্যাম্পাসে মৌলবাদের চর্চা হচ্ছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীর, জেএমবি ও ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে পোস্টার লাগাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের ই-মেইলে দাওয়াত দিচ্ছে, নানা জায়গায় মিটিং করছে। সাধারণ ছাত্রদের এটাও বলতে শোনা যায়, রুম থেকে বের হওয়ার সময় বড় ভাইদের বলে যেতে হয় সে কোথায় যাচ্ছে এবং কখন ফিরবে। এই বড় ভাই আসলে কারা? তাদের বিষয়ে এ দেশের কতজন ভেবেছে? আবরারের হত্যাকাণ্ড জাতির জন্য দুঃখজনক। আবরার মারা গেছে কিন্তু মানবিকভাবে প্রতিনিয়ত বুয়েটে অসংখ্য শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশকে ভলোবাসার সেখানে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। যা বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। বাংলাদেশ গড়বে তাহলে কারা?

ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন গত ৩১ মার্চ জাতীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভায় বলেছেন ‘বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে।’ ছাত্রলীগের নেতারা আরো বলেছেন, ‘বুয়েট বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থে পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সর্বাবস্থায় এই রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের দ্বারা এটি পরিচালিত হতে হবে। কিন্তু তা না করে এই আইনের কোথাও ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা বুয়েটকে দেওয়া না হলেও বুয়েট প্রশাসন বেআইনি ও অসাংবিধানিকভাবে তা বাস্তবায়ন করছে। মূলধারার প্রকাশ্য ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে বুয়েটকে দেশ ও বিশ্ব মানবতাবিরোধী নিষিদ্ধ, অন্ধকার জগতের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার তীর্থস্থানে পরিণত করা হয়েছে।’ ছাত্রলীগের কথা শতভাগ সত্য।

আপনারা সবাই জানেন, বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্ম কীভাবে হয়েছে? ছাত্ররাজনীতি না থাকলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আদৌ জন্ম হতো কি না সন্দেহ। আজকে আমরা যাকে জাতির পিতা হিসেবে জানি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছেন। তিনি যখন কলকাতায় পড়তেন, তখন তিনি ছাত্রসংসদের জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি যদি ছাত্ররাজনীতি না করতেন, তাহলে কী তিনি সত্যিকারের রাজনীতি শিখতেন? বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করতে পারতেন? দাবি ও অধিকারের কথা বলতে পারতেন?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি বঙ্গবন্ধুর জীবনকে প্রকৃত রূপ দেয়। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও ১ বছর আগে তার নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ (বর্তমান নামণ্ডবাংলাদেশ ছাত্রলীগ) প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এটি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেন (পৃষ্ঠা : ৮৮, ৮৯), ‘১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হলো, সেখানে স্থির হলো একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে, যার নাম হবে “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ”। প্রতিষ্ঠানের অফিস করলাম ১৫০ নম্বর মোগলটুলী। মুসলিম লীগ নেতারা কয়েকবার চেষ্টা করেছেন এই অফিসটা দখল করতে, কিন্তু শওকত মিয়ার জন্য পারেন নাই।’

বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, নেতৃত্ব দেন এবং ছাত্রলীগকে এই আন্দোলনে একীভূত করেন। যাই হোক, এই প্রচেষ্টায় তার নেতৃত্ব তাকে কারারুদ্ধ করেছিল। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ বহিষ্কৃত হন। তখন তিনি আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে তাকে এবং আরো চারজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী পরিষদ বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিবারের মাধ্যমে মুচলেকা ও ১৫ টাকা জরিমানার বিনিময়ে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য চারজন ছিলেন কল্যাণ চন্দ্র দাশগুপ্ত, নাঈমউদ্দিন আহমেদ, নাদেরা বেগম এবং আবদুল ওয়াদুদ। এরা সবাই জরিমানা এবং মুচলেকা দিলেও বঙ্গবন্ধু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি এবং ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নেননি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিলের আদেশ ৬১ বছর পর প্রত্যাহার করে নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১০ সালে। সিন্ডিকেট সভায় পাস হয়। উপাচার্য ছিলেন আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি আচার্য থাকা অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। এখন বুঝতে হবে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা আমাদের দেশে এবং জাতীয় রাজনীতিতে কতটা। ১৯৫২ সাল আসত না যদি এ দেশে ছাত্ররাজনীতি না থাকত। বাংলাদেশের সাধারণ শ্রমিক-কৃষক ভাষা আন্দোলন করেননি। তাদের সে সময়ে এ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। যেমন দেখেছি ৬৯ সালে সব ধরনের মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে। ১৯৫২ সাল তেমন ছিল না। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন, যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দেওয়াসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক আন্দোলনে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক বিজয়ে অবদান রেখেছিল এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল, গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছিল। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামরিক শাসনের সময় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও ছাত্রলীগ গণতান্ত্রিক নীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে কাজ অব্যাহত রাখে। তারা সক্রিয়ভাবে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেছিল, ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিল।

শেখ মুজিবুর রহমান যখন গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেল থেকে মুক্তি পেলেন, তখন ছাত্ররা তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। ছাত্রদের পক্ষে তখনকার ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যে শব্দটি শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সমার্থক হয়ে আছে। আমরা তাকে বঙ্গবন্ধু হিসেবেই চিনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা মিছিল করেছিল তারা ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাদে বাংলাদেশের অন্য অনেক ছাত্রসংগঠনও বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বিশেষ করে ছাত্রদের অধিকারে কাজ করেছে। যেমন : বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। আবার কিছু সংগঠন বাংলাদেশবিরোধী কাজ করেছে। যেমন : বাংলাদেশ ছাত্রশিবির। কিছু ছাত্রসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যক্রম করেছে। যেমন : জাসদ ছাত্রলীগ। ছাত্ররাজনীতির কলুষিত অংশ আগেও ছিল। তবে এখন ভয়ংকর রকম বেড়েছে। এ থেকে বের হতে হবে। এটা সময়ের দাবি। বুয়েটের যে নিরীহ ছাত্র কোনো কারণ ছাড়াই ছাত্ররাজনীতি চায় না, তার কারণ তো অবশ্যই আছে। সেটা হলো বঙ্গবন্ধুর মতো আদর্শ নিয়ে সবাই রাজনীতি করে না। এমনকি তোফায়েল আহমেদের মতো বা বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মতো ছাত্রনেতা দরকার। সাধারণ ছাত্রদের ভয়ের কারণ হয় এমন বহু ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। এ জন্যই বুয়েটের নিরীহ ছাত্রটির এই দশা।

লেখক : অধ্যাপক ও সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close