সঞ্জয় মিত্র চৌধুরী
দৃষ্টিপাত
নতুন শিক্ষাক্রম : শিক্ষায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ
নতুন শিক্ষাক্রম- শিক্ষায় এক অভূতপূর্ব, সাহসী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যুগোপযোগী, সৃজনশীল, মানবিক ও বিশ্ব নাগরিক চৈতন্য ধারণসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে আজকের শিক্ষার্থীদের তৈরি করার তাগিদ থেকে শিক্ষার এই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন অনিবার্য ছিল। এই পরিবর্তনকে অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে গেলে আমরা বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়তাম, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই পরিবর্তন, মানুষ হিসেবে আমাদের জীবনেও ছাপ ফেলে প্রতিনিয়ত। কিছু পরিবর্তন আমরা অনুধাবন করতে পারি, আবার কিছু পরিবর্তন আমাদের অনুভূতিকে স্পর্শ করে না। বিশ্বসভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে পরিবর্তনটা সহজে অনুধাবন করা যায়। অন্যদিকে প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ও বিকাশের ফলে বৈশ্বিক পরিবর্তনটা আরো ত্বরান্বিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন বয়স্কদের থেকে কম বয়সি শিক্ষার্থীদের মনোজগতে বিশাল প্রভাব ফেলছে। এই প্রভাবটা যে সব সময় নৈতিক সীমারেখা মেনে চলছে তা নয়, আবার এই বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। এ জন্য আমাদের শিক্ষার্থীর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় একদিকে দেশীয় ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতিকে ধারণ করবে, অন্যদিকে মানবিক, সৃজনশীল, কর্মক্ষম, বিশ্বমনন ও আধুনিকতার ছোঁয়া থাকবে।
দক্ষ পেশাজীবী শ্রেণি তৈরি করা শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য নয়। শিক্ষার লক্ষ্যটা আরো ব্যাপ্ত। দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন দরকার। আর এই পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে নতুন কারিকুলামে। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ বেঞ্জমিন ব্লুম ১৯৫৬ সালে ‘টেক্সোনমি অব এডুকেশনাল অবজেকটিভস’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, ব্লুম তার গ্রন্থে শিখনের তিনটি ক্ষেত্র নির্ধারণ করেন। ক্ষেত্রগুলো হলো- ১। জ্ঞানীয়, ২। আবেগীয় ও ৩। মনোপেশীয়। ব্লুমের এই মতবাদকে ধারণ করে সৃজনশীল ধারা প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু এই সৃজনশীল ধারার প্রয়োগ ক্ষেত্রটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরীক্ষানির্ভর হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিদ্যার্থী না হয়ে পরীক্ষার্থী হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা গেছে। জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন থেকে সেরা গ্রেডনির্ভর সনদপ্রাপ্তির গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল। এদিক থেকে বিবেচনা করলেও আমাদের শিক্ষাক্রমের এই পরিবর্তন সময়োপযোগী। বর্তমান শিক্ষাক্রম হচ্ছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখন-শেখানো কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। নতুন এই অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রবক্তা আমেরিকান এডুকেশনাল থিউরিস্ট- ‘ডেবিড এলান ক্লব’, তার নামানুসারে এই পদ্ধতিকে ‘ক্লব’স লার্নিং সাইকেল’ বলা হয়। এই শিখন পদ্ধতির চারটি ধাপ হচ্ছে- ১। প্রেক্ষাপটনির্ভর শিখন, ২। প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ, ৩। বিমূর্ত ধারণায়ন ও ৪। সক্রিয় পরীক্ষণ। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকটি বিষয়ের অভিজ্ঞতাগুলো এই চারটি ধাপ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতাগুলো অর্জন করবে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যোগ্যতায় চারটি উপাদান সন্নিবেশিত রয়েছে। উপাদানগুলো হলো- জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষাক্রমে যোগ্যতা বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বিত সক্ষমতা অর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখা।’ মূল্যবোধের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় সংহতি, দেশপ্রেম, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা ও শুদ্ধাচারকে। দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছে- ১। ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ২। ইতিবাচক সামাজিক রীতি সম্পর্কিত বিশ্বাস ও ৩। আত্মবিশ্বাস। আর দক্ষতার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে- ১। মৌলিক দক্ষতা, ২। রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা ও ৩। জীবিকাণ্ডসংশ্লিষ্ট দক্ষতা। এ ছাড়া নতুন এই শিক্ষাক্রমে কোমল দক্ষতার (সফট স্কিল) বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। কোমল দক্ষতাগুলো হলো- যোগাযোগ দক্ষতা, দলগত কাজ ও সহযোগিতা, সমস্যা সমাধান, উপযোগীকরণ, নেতৃত্ব প্রদান ও সময় ব্যবস্থাপনা। এই দক্ষতাগুলো শিক্ষার্থীর অর্জন করা খুবই জরুরি। কারণ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই দক্ষতা অত্যাবশ্যকীয়। গুরুত্বপূর্ণ যে বৈশিষ্ট্যটি আলোচনা করা দরকার তা হলো আমাদের দেশে এত দিন ধরে শিক্ষা ছিল শিক্ষককেন্দ্রিক, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক সহায়তাকারী বা দিকনির্দেশনাকারীর ভূমিকা পালন করবে। সমগ্র শিখন কার্যক্রম শিক্ষার্থীকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হবে। শিক্ষা শুধু শ্রেণিকক্ষ বা বিদ্যালয়কেন্দ্রিক হবে না, শিক্ষার্থীর শিখনের উৎস হবে পরিবার, সমাজ তথা বিশ্বপ্রকৃতি। তথ্য অনুসন্ধান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা শিক্ষক, সহপাঠী ও বড়দের কাছ থেকে সহায়তা নিতে পারবে।
ক্ষেত্রবিশেষে পরিমিতভাবে নৈতিকতা মেনে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিতে পারবে। কবি সুনির্মল বসুর কবিতা- ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর/সবার আমি ছাত্র/নানান ভাবের নতুন জিনিস/শিখছি দিবারাত্র।’ এই কবিতাটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। অর্থাৎ শিক্ষার্থী আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় উৎস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। নতুন শিক্ষাক্রমে এ বিষয়টিকে উন্মুক্ত করা হয়েছে ও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন প্রক্রিয়ায় বাস্তব উপাদান ও উৎস সন্নিবেশিত হওয়ায় শিখন অর্জন অনেকাংশে দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে নিজেকে সহজে মানিয়ে নিতে পারবে। তা ছাড়া শিক্ষাকে জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১-এর রূপকল্প হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা।’ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আগামী দিনের নাগরিকদের সামগ্রিক আদর্শ চরিত্র এই বাক্যে চিত্রিত হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল যোগ্যতা দশটি। এই মূল যোগ্যতাগুলো শিক্ষার্থীরা প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম সম্পন্ন করে অর্জন করবে। এই মূল যোগ্যতা অর্জনের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে (ষষ্ঠ-দশম শ্রেণি) দশটি শিখন ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বিষয়গুলো হবে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন। বিষয়গুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতি, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা এবং ধর্মশিক্ষা। প্রত্যেকটি বিষয়ের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সুনির্দিষ্ট বিষয়ের সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা অর্জন করবে।
বছরব্যাপী ধারাবাহিক মূল্যায়ন বা শিখনকালীন মূল্যায়ন বা গাঠনিক মূল্যায়ন ও বছরে দুবার সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর যোগ্যতার পারদর্শিতার সূচক নিরূপণ করা হচ্ছে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিখনকালীন মূল্যায়ন বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। শিখনকালীন মূল্যায়নের ফলে শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি নিরূপণ করে শিক্ষক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এর আরো একটি নতুন সংযোজন হচ্ছে শিক্ষার্থীর বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতার সূচকের সঙ্গে সঙ্গে আচরণিক সূচক নিরূপণ। এতে করে শিক্ষার্থীকে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে শিখনকালীন মূল্যায়ন ও সামষ্টিক মূল্যায়নের সমন্বয়ে শিক্ষার্থীর সনদপ্রাপ্তির দিকটিও নিশ্চিত হয়েছে। সারা বছর ধরে শিখনকালীন মূল্যায়নের ফলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ও সক্রিয়তা বাড়বে। এতে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার হার কমবে। মুখস্থনির্ভর শিখন পদ্ধতি ও পেপার-পেনসিল টেস্টের আধিক্য কমায় শিক্ষার্থীরা আনন্দদায়ক পরিবেশে সক্রিয়তার সঙ্গে শিখন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে। নতুন শিক্ষাক্রমে সাপ্তাহিক ছুটি এক দিনের পরিবর্তে দুদিন করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও নতুন নতুন কর্মপরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য শিক্ষার্থীদের গতানুগতিক ধারার পরিবর্তে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন পদ্ধতি বেশ কার্যকর এবং স্বীকৃত। এই শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত বিষয়ভিত্তিক কনটেন্টগুলো আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে প্রণীত হয়েছে। আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুভূতির ওপর শ্রদ্ধা পোষণ করে বিন্যস্ত বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতাগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। একই সঙ্গে সমান্তরালভাবে গুরুত্ব পেয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা। দেশীয় সংস্কৃতিকে ধারণ করে আধুনিক ও মানবিক বিশ্বনাগরিক হওয়ার শিক্ষা আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারব, যদি এই শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়।
নতুন শিক্ষাক্রম আধুনিক অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন পদ্ধতি। এজন্য এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, বিশেষ করে সম্মানিত শিক্ষকম-লীর আন্তরিক প্রচেষ্টা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রিয় শিক্ষার্থীদের উৎসবমুখর পরিবেশে অংশগ্রহণ, সম্মানিত অভিভাবকের আস্থা ও সম্মানিত শিক্ষকদের আন্তরিকতার সমন্বয় ঘটলে এই পদ্ধতিতে আমাদের শিক্ষায় বিপ্লব ঘটে যাবে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক
"