রাহাত চৌধুরী, জাবি

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

টর্চার সেল ৩১৭

যারা একটু বয়সে সিনিয়র; বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন বা সে সময়ের অনেক কাহিনি শুনেছেন, তারা সাধারণত টর্চার সেল কথাটি শুনলে সে সময়ের পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের নির্যাতনের জন্য তৈরি করা বাড়ি বা কক্ষকে বোঝেন। প্রায় প্রতিটি জেলা বা উপশহরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় টর্চার সেল ছিল। তবে বর্তমান সময়ে টর্চার সেল নামের যে শব্দটি শোনা যায়, তার অবস্থান দেশের একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয়।

মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি রুমকে নির্দিষ্ট করা হয়, সেখানে অনেক সময় লাঠি বা আঘাত করার যন্ত্রপাতিসহ থাকে বিভিন্ন অস্ত্র। কক্ষের ওপর টর্চার সেল লেখা না থাকলেও সেই কক্ষগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকে গেস্টরুম, মিনি গেস্টরুম, সিঙ্গেল মিনি গেস্টরুম, মোস্ট পলিটিক্যাল ভাইদের রুম ইত্যাদি। যেখানে বিভিন্ন কায়দায় শিক্ষার্থীসহ বহিরাগত অনেকের ওপর চালানো হয় অমানবিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ত্রাস সৃষ্টির পরিকল্পনাও হয়ে এসব রুমে। সঙ্গে থাকে আরো নানামুখী ষড়যন্ত্র।

তেমনই এক টর্চার সেলের অস্তিত্ব মিলেছে জাবির মীর মশাররফ হোসেন হলে। হলটির এ-ব্লকের ৩১৭ নম্বর রুমটিকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন হল ছাত্রলীগের নেতারা। বিভিন্ন সময় কক্ষটিতে বহিরাগত লোকজন এবং শিক্ষার্থীদের শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো বলে জানা গেছে। তবে কক্ষটি সবার নজরে আসার পশ্চাতে রয়েছে ন্যক্কারজনক একটি ঘটনার। গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে জিরানি এলাকার এক ডেকোরেটর ব্যবসায়ীকে কক্ষটিতে আটকে নির্যাতন করেন হল ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। তবে তারা ওই ব্যবসায়ীকে নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হননি, বরং মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে এসে তার স্ত্রীক হলসংলগ্ন বনাঞ্চলে দলবদ্ধ ধর্ষণ করেন। ঘটনার মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক।

ভুক্তভোগী বরাতে জানা যায়, ভুক্তভোগী দম্পতির বাড়িতে একসময় ভাড়া থাকতেন আরেক অভিযুক্ত বহিরাহত মামুন। মামুনের সঙ্গে পরিচয় ছিল মুস্তাফিজের। সেই সূত্রে পরিচয়ের ভিত্তিতে শনিবার সন্ধ্যায় ভুক্তভোগীর স্বামীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে আনেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এলে তাকে মীর মশাররফ হোসেন হলের এ-ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে আটকে রাখেন মামুন ও মোস্তাফিজ। পরে তার স্ত্রীকে দিয়ে তাদের বাসায় রেখে আসা নিজের জিনিসপত্র আনতে বলেন মামুন। ফোনে খবর পেয়ে মামুনের জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন ভুক্তভোগী নারী। এ জিনিসপত্র নিয়ে হলের এ-ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে রেখে আসেন মামুন। পরে তার স্বামী পেছনের গেট দিয়ে আসবেন জানিয়ে ওই নারীকে হলসংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে যান অভিযুক্তরা। সেখানে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ওই নারী।

এদিকে সরেজমিন দেখা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষটি বাইরে থেকে হলের অন্য আট-দশটা রুমের মতোই সাধারণ একটি কক্ষ। কিন্তু এর ভেতরে গেলে দেখা মেলে নির্যাতন ও মাদকসেবনের বিভিন্ন আলামত। খাটের নিচে দেখা মেলে কয়েকটি রড ও লাঠি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাখা ছাত্রলীগের এক যুগ্ম সম্পাদকের কাছ থেকে জানা যায়, হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষটিকে অভিযুক্তরা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন এবং ওই কক্ষে তারা নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতেন। এছাড়া সিঅ্যান্ডবি, ডেইরি গেট ও হলের সামনের দোকানগুলো থেকে তারা নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন। তাদের অত্যাচারে হলের সাধারণ শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দোকানদাররা অতিষ্ঠ।

গত বছরের ২৫ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে মাসে ৬ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে ২৪টি লেগুনা আটকে রাখেন শাখা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার সঙ্গে মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান ও অন্যদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এছাড়া মীর মশাররফ হোসেন হলের রাস্তায় ছিনতাই, হলসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সিঅ্যান্ডবি এলাকায় নিয়মিত ছিনতাইয়ের সঙ্গেও অভিযুক্তদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সিঅ্যান্ডবি, ডেইরি গেট ও হলের সামনের দোকানগুলো থেকে অভিযুক্তরা নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন বলে জানিয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের এক নেতা। গত বছরের ২১ মার্চ মীর মশাররফ হোসেন হলের অতিথিকক্ষে ছাত্রলীগের গেস্টরুম চলাকালীন এক জুনিয়র ছাত্রকে চড় মেরে কান ফাটানোর ঘটনার সঙ্গেও অভিযুক্তরা জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে।

জানা যায়, সে কক্ষে থাকতেন ভুক্তভোগীকে মারধর ও ধর্ষণের অভিযোগে আরেক অভিযুক্ত মুরাদ হোসেন। দ্বিতীয় তলার ‘পলিটিক্যাল ব্লকের ২২৮ নম্বর কক্ষে তার নির্দিষ্ট কক্ষ থাকলেও ৩১৭ নম্বর কক্ষটি দখল করে মাদক গ্রহণ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন অভিযুক্ত মুরাদ ও তার বন্ধু সাগর সিদ্দিকী। এর আগে ৩১৭ নম্বর কক্ষে আশুলিয়া থানার একজন পুলিশ কনস্টবলকে আটকে রেখে ৫০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সমঝোতায় ঘটনাটি তখন ধামাচাপা দেওয়া হয় বলে জানা যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৩১৭ নম্বর কক্ষ ছাড়াও এমন আরো ১০-১১টি কক্ষ দখল করে এমন কর্মকাণ্ড পরিচলানা করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। পলিটিকাল ব্লকের ২৩২/বি নম্বর কক্ষে সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল ফারুক ইমরান থাকলেও তিনি এ-ব্লকের ২৩৫ নম্বর কক্ষটি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। গ্রেপ্তার সাগর সিদ্দিকী ২৩৮/বি নম্বর কক্ষে থাকলেও তিনি একই ব্লকের চতুর্থ তলার ৪৩১ নম্বর কক্ষটি সম্প্রতি দখল করেন। এছাড়া অছাত্রদের হলত্যাগের লক্ষ্যে হল প্রশাসনের চলমান পদক্ষেপ চলাকালীনও অনেকগুলো কক্ষের তালা কেটে দখল করেছেন আরেক যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের অনুসারীরা। এরই মধ্যে এ-ব্লকের ২৩৩ ও ২৬৩ নম্বর কক্ষসহ অনেকগুলো কক্ষ দখলের অভিযোগ রয়েছে তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

হলের কক্ষ অবৈধভাবে দখল করে রাখার বিষয়ে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক সাব্বির আলম বলেন, অবৈধ ছাত্রদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে আমরা অন্তত ১৪টি কক্ষ সিলগালা করেছি। আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে এ চিত্র শুধু মীর মশাররফ হোসেন হলেরই না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের বিভিন্ন হলে বিভিন্ন কক্ষের আড়ালে টর্চার সেলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ সালাম-বরকত হলের ২১৪/এ কক্ষে এক বহিরাগতকে নেশাদ্রব্য খাইয়ে মারধর করে ৪৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক অসিত পালের বিরুদ্ধে। পরে এ ঘটনায় তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এছাড়া মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষকে টর্চার সেল বানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ছোট ভাই আরমান খান যুব। ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলেও প্রভাব খাটিয়ে কক্ষটিকে টর্চার সেল হিসেবে গড়ে তুলেছেন তিনি। সেখানে প্রায়ই বাইরে থেকে লোক ধরে এনে মারধর করেন যুব। মাদকের কারবারও চলে ওই কক্ষে। এছাড়া গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটির ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের উপতথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক জাহিদ হাসান ইমনকে ওই কক্ষে এনে মারধর করেন যুব। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে বিভিন্ন সময়ে তৃতীয় তলার ব্লকের বিভিন্ন কক্ষে ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতারা কর্মীদের বিভিন্ন কারণে এনে নির্যাতন করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, এ ধরনের কোনো রুম যদি থেকে থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও হল প্রশাসনকে এ বিষয়ে আরো তৎপর হওয়ার জরুরি। ছাত্রলীগের কেউ যদি জড়িত থাকে এবং তা যদি প্রমাণ হয়, তাহলে সে যেই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানতে চেয়ে প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসানকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close