মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি

  ২১ মে, ২০২৪

নওগাঁয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দে অনিয়ম-দুর্নীতি

নওগাঁর মহাদেবপুরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচিতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) বিরুদ্ধে। সরকারি বরাদ্দের অর্থ পরিশোধে নিয়মণ্ডনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। বিতরণ করা হয়েছে নগদ টাকা। নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নওগাঁ-৩ আসনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ করা অর্থে পিআইওর কমিশন বাণিজ্য নিয়ে এলাকায় বইছে সমালোচনার ঝড়। চলছে নানা তর্ক-বিতর্ক। এটিকে দুর্নীতি হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন এলাকার মানুষজন। সুশাসন বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সনীতি বাস্তবায়নে আরো কঠোর হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের লাগাম টেনে ধরতে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সরকারি প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সংশ্লিষ্টদেরই নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা। তবে এ অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু বক্কার সিদ্দিক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের সংসদ সদস্য সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক (তৃতীয় পর্যায়) মহাদেবপুর উপজেলায় গত ৩ মার্চ ‘বাজাসস/৪৮ নওগাঁ-৩/২০২৪/০৩৬’ নম্বর ডিওতে প্রকল্প দাখিল করেন। এতে মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা, কবরস্থান, ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, উপজেলা পরিষদ অফিসার্স কোয়াটার সংস্কারসহ পৃথক ৬৬টি প্রকল্পের প্রত্যেকটিতে ৬০ হাজার টাকা করে ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। অভিযোগ রয়েছে, বরাদ্দের অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধের নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। সরকারি নিয়মণ্ডনীতি উপেক্ষা করে প্রকল্পের বিল পরিশোধের জন্য অফিস খরচ বাবদ শতকরা প্রায় ১২ শতাংশ হারে কমিশন কেটে রেখে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তর থেকে নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সেই হিসেবে বরাদ্দপ্রাপ্ত ওই ৬৬টি প্রকল্প থেকে কমিশন বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২০০ টাকা।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স সংস্কারের জন্য ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও সংস্কারকাজের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। কমপ্লেক্সটির প্রাচীরসহ বিভিন্ন স্থান সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। টিআর প্রকল্পে বরাদ্দপ্রাপ্ত উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের রনাইল নিচপাড়া যুব ক্লাবে মেলেনি সংস্কারকাজের সন্ধান। ক্লাবের কার্যক্রমও সচল নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা দেখালেন রনাইল মাঠসংলগ্ন একটি পরিত্যক্ত ইটের ঘর। নেই ছাদ বা টিনের চালা। ঘরের মধ্যে জঙ্গল আর ঘাসে ভরা। মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়সংলগ্ন উপজেলা পরিষদ অফিসার্স কোয়াটার সংস্কারের জন্য বরাদ্দে নামমাত্র কয়েক ট্রাক্টর মাটি কেটে হালাল করা হয়েছে প্রকল্পের অর্থ। দৃশ্যমান তেমন কোনো সংস্কারকাজ চোখে পড়েনি। দু-একটি ব্যতিক্রম হলেও অধিকাংশ প্রকল্পের চিত্র প্রায় একই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে মহাদেবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন আবু বক্কার সিদ্দিক। এরপর প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় গড়ে তোলেন নিজস্ব কমিশন সিন্ডিকেট। এর সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন। প্রকল্প থেকে কমিশন আদায় করেন তারা। সিন্ডিকেটটির সদস্যরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেন না কেউই। তবে বিষয়টি স্থানীয় সচেতন বাসিন্দাদের কাছে ওপেন সিক্রেট। এদিকে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরে গড়ে ওঠা শক্তিশালী ওই সিন্ডিকেটের ব্যাপারে নওগাঁ-৩ আসনের সংসদ সদস্য, নওগাঁর জেলা প্রসাশক ও মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন উপজেলার বাসিন্দারা। দ্রুত আইন প্রয়োগের দাবি তাদের।

মহাদেবপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আবদুল করিম। কয়েক বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে রয়েছে তার পানের দোকান। জানতে চাইলে তিনি জানান, এটি নির্মাণের পর আর কোনো সংস্কারকাজ হয়নি। ভবনটি হস্তান্তরের পর থেকে এ পর্যন্ত এক কোদাল মাটিও ফেলা হয়নি বা এক কড়াই সিমেন্টেরও কাজ হতে তিনি দেখেননি। একই কথা জানান, আরো ১০ থেকে ১২ জন স্থানীয় বাসিন্দা। বরাদ্দপ্রাপ্ত রনাইল নিচপাড়া যুব ক্লাবের সভাপতি আইয়ুব আলী জানান, গত ঈদের আগে ক্লাব সংস্কারের জন্য কমিটি ৫০ হাজার টাকা পেয়েছে বলে শুনেছেন। সেটি স্থানীয় নেতা শফিকুলের কাছে জমা রয়েছে। বরাদ্দের অর্থ উত্তোলন করতে ক্লাবের কাউকে উপজেলায় যেতে হয়নি। প্রকল্পের তালিকা দেখিয়ে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দের স্থলে ৫০ হাজার টাকা কেন পেলেন- প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, লিডাররা যা করেছেন তাই। ক্লাবে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দের বিষয়ে তাদের জানানো হয়েছে বলে দাবি তার। রনাইল পূর্বপাড়া মসজিদের সভাপতি মোজাম্মেল হক জানান, মসজিদ সংস্কারে এমপির টিআর কর্মসূচি থেকে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু অফিস খরচ শেষে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পেয়েছেন নগদ ৫৩ হাজার টাকা। বরাদ্দের অর্থ উত্তোলন করতে ব্যাংকে যেতে হয়নি বলেও জানান তিনি। সরকারিভাবে প্রতিটি প্রকল্পে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কর্মকর্তাদের কমিশন ও অফিস খরচ বাদে নগদ ৫৩ হাজার করে টাকা পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন সংস্কারের জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত খাতিজা দারুল উলুম কওমি মাদরাসার মুহতামিম আবদুল বারী, খাজুর পলিপাড়া দুর্গা মন্দিরের সভাপতি বিমল চন্দ্র, মর্ত্তুজাপুর মধ্যপাড়া মসজিদের সাধারণ সম্পাদক তায়েজ উদ্দিন, জোয়ানপুর কবরস্থানের সভাপতি এস এম আবদুল মান্নান প্রমুখ।

সম্প্রতি মহাদেবপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে একটি বৈঠকে প্রতিবেদকের কাছে কমিশন বাণিজ্য এবং নগদ অর্থ বিতরণের কথা স্বীকার করেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু বক্কার সিদ্দিক। পরে সংবাদ প্রকাশের জন্য তার বক্তব্য জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি জানান, যা বরাদ্দ তাই, প্রকল্পের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা তার দপ্তর থেকে নিয়ে গেছে। বিলের মাধ্যমে বরাদ্দের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বলে দাবি করেন এই সরকারি কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে মুঠোফোনে নওগাঁ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আশেকুর রহমান জানান, সরকারি প্রকল্পে কমিশন আদায় ও নগদ অর্থ বিতরণের সুযোগ নেই। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close