ইমরান হোসেন সুজন, নবাবগঞ্জ (ঢাকা)

  ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ইতিহাসের সাক্ষী পঞ্চম গির্জা!

ঢাকার নবাবগঞ্জে হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের লোকজন মিলেমিশে বসবাস করেন। প্রত্যেক ধর্মের মানুষের মধ্যে রয়েছে আন্তরিকতা। জাতি, ধর্ম বা বর্ণ কোনো কিছুতেই নেই ভেদাভেদ। সব ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পালিত হয় মহাধুমধামে। মুসলমানদের ঈদ, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা পার্বণ এবং খ্রিস্টানদের বড়দিন বা স্টার সানডেতে সব ধর্মের মানুষই অংশগ্রহণ করে। নবাবগঞ্জ উপজেলায় মুসলমানদের যেমন রয়েছে ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ভাঙা মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, সনাতন ধর্মের দুই শতাধিকের ওপরে মন্দির, তেমনি খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের উপাসনা করার জন্য রয়েছে পাঁচটি দৃষ্টিনন্দন গির্জা। এরই মধ্যে নবাবগঞ্জ একটি অসাম্প্রদায়িক এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানেই অবস্থিত অবিভক্ত বাংলার পঞ্চম গির্জা। যা নবাবগঞ্জের অন্যতম আকর্ষণ। গির্জাগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। জানা যায়, নবাবগঞ্জের পার্শ্ববর্তী দোহার উপজেলার মালিকান্দা ছিল ঢাকা দক্ষিণে বসবাসকারী খ্রিস্টানদের আদি নিবাস। পদ্মার ভাঙনসহ বিভিন্ন কারণে আনুমানিক ১৭৭০-৭৬ সালে মালিকান্দা থেকে পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরা ইউনিয়নের হাসনাবাদ গ্রামে এসে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতে শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে তারা উপজেলার গোল্লা, তুইতাল, বক্সনগর, সোনাবাজুসহ আরো কয়েকটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। হাসনাবাদে ১৭৭৭ সালে ফাদার রাফায়েল গমেজ নামে এক যাজক এই অঞ্চলের প্রথম গির্জা তৈরি করেন। যার নামকরণ করা হয় রানির পবিত্র জপমালা গির্জা বা ছঁববহ’ং ঐড়ষু জড়ংধৎু ঈযঁৎপয। গির্জাটিতে তখন পাকা ভবন ছিল না। ১৮৮৮ সালে গির্জাটির সংস্কার করে পাকা ভবন তৈরি করা হয়। তখন উপজেলার গোল্লা, তুইতাল ও বক্সনগর ধর্মপল্লী হাসনাবাদের অধীনে ছিল। এটি অবিভক্ত বাংলার পঞ্চম গির্জা বলে জানান স্থানীয়রা। যা নবাবগঞ্জের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ২০০২ সালে পুনরায় ‘রানির পবিত্র জপমালা গির্জা’র সংস্কার করা হয়। প্রতি রোববার স্থানীয় খ্রিস্টান ধর্মভিরু লোকজন এখানে বিশেষ প্রার্থনায় জন্য একসঙ্গে মিলিত হন। বর্তমান উপজেলায় আরো চারটি গির্জা নির্মিত হলেও যেকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই গির্জায় লোক সমাগম বেশি হয়। বড়দিন বা স্টার সানডের অনুষ্ঠান মহাধুমধামে পালন করা হয় গির্জাটিতে। দৃষ্টিনন্দিত এই গির্জাটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। গির্জা সংলগ্ন সুন্দর ও পরিপাটি করবস্থান। এর সামনে রয়েছে বিশাল খেলার মাঠ। যা গির্জার সৌন্দর্যকে আরো বিকশিত করেছে।

হাসনাবাদ সেন্ট ইউফ্রেজিস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার মেবেল কস্তা বলেন, উপজেলার সবচেয়ে বড় এই পবিত্র গির্জায় প্রতিদিনই ধর্মভিরুদের ভিড় থাকে। তবে রোববার বিশেষ প্রার্থনা দিন বিপুল লোকের সমাগম ঘটে গির্জাটিতে। এছাড়া গির্জাটি একনজর দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্তের লোকজন আসে। নবাবগঞ্জ উপজেলা একটি অসম্প্রদায়িক এলাকা। এখানে সব ধর্মের মানুষই অত্যন্ত শান্তিতে বসবাস করছে। যেকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সব ধর্মের মানুষই সহযোগিতা করেন।

এছাড়া আরো কয়েকটি গির্জা রয়েছে নবাবগঞ্জে। ১৭৭৭ সালে পর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতে থাকেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাসনাবাদের পার্শ¦বর্তী পুরাতন বান্দুরায় একটি গির্জা তৈরি করা হয়। ১৮৪৫ সালে হাসনাবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরাতন বান্দুরায় নবনির্মিত গির্জায় যোগদান করে গোল্লা ও বক্সনগর ধর্মপল্লী। বেশ কয়েকবার স্থান বদল, পুনর্নির্মাণ, একবার নাম বদলের পর ১৯৬৫ সালে বর্তমান গোল্লা গির্জা ভবন তৈরি করা হয়। গির্জার নামকরণ করা হয় সাধু ফ্রান্সিস জোভিয়ারের গির্জা।

১২০ বছর হাসনাবাদের অধীন থাকার পর ১৮৯৪ সালের ১৫ মে তুইতাল ধর্মপল্লী প্রতিষ্ঠিত হয়। তুইতাল ধর্মপল্লী প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত বকচরে আরেকটি গির্জা ছিল। কালবৈশাখী ঝড়ে ধ্বংস হওয়ায় ১৯২৪ সালে পবিত্র আত্মার গির্জা নামে একটি নতুন গির্জা নির্মিত হয়। প্রায় ৭০ বছর পর ১৯৯৩ সালে পুরোনো গির্জা ভেঙে বর্তমানের গির্জাটি নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা এখন নতুন গির্জায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করেন।

আঠারো গ্রামের গোল্লার অধীন আরেকটি ধর্মপল্লী বক্সনগর। ১৮৯৪ সালে বক্সনগরে নির্মাণ করা হয় পাদুয়ার সাধু আন্তনীর গির্জা। এটি বক্সনগরের প্রথম গির্জা। গির্জার পাশেই রয়েছে কবরস্থান। পুরোনো গির্জা থেকে মিনিট তিনেক হাঁটলেই নতুন গির্জা। ২০০৫ সালে পুরোনো গির্জার অনুকরণে নতুন গির্জাটি তৈরি করা হয়। চারদিকের গাছপালার মাঝে সুন্দর গির্জাটি দেখলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে।

উপজেলা নিরিবিলি আরেকটি গ্রাম সোনাবাজু। এখানেই ১৯৪৫ সালে তুইতাল ধর্মপল্লীর অধীনে একটি গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরোনো গির্জাটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে ১৯৮১ সালে নতুন গির্জা ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমান এটি ‘ফাতেমা রানির গির্জা’ নামে পরিচিত। হাসনাবাদ ধর্মীপল্লীর অধীনে ইকরাশিতে হাসনাবাদের অধীনে ২০০৩ সালে সাধু যোসেফ চ্যাপেল এর নামে একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়। এটি দোহারের একমাত্র গির্জা। বান্দুরা ইউপি চেয়ারম্যান হিল্লাল মিয়া বলেন, ‘রানির পবিত্র জপমালা গির্জা নবাবগঞ্জের একটি ঐহিত্য। আর এটি আমার ইউনিয়নে হওয়ায় আমি সব সময় চেষ্টা করি গির্জার কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে। বান্দুরা ইউনিয়নের মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর লোকজন অত্যন্ত শান্তিতে বাস করছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close