সাধন সরকার

  ০৪ জুন, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের দরুন ২০৭০ সাল নাগাত বিশে^র ৩০০ কোটি মানুষকে ‘প্রায় বসবাস-অযোগ্য’ চরম উষ্ণ তাপমাত্রার মধ্যে থাকতে হবে। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল সিস্টেমস ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ টিম লেন্টন কর্তৃক চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিজ্ঞানীদের নিয়ে এই সমীক্ষা করা হয়েছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যদি গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমানো না যায়, তাহলে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষকে গড়ে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়েও বেশি তাপমাত্রায় বসবাস করতে হবে। গবেষণায় সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার গরিব মানুষের ওপর। আবার জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্যারিস চুক্তি মেনে নেওয়ার পরও পৃথিবীর তাপমাত্রা কমবে না, বরং বাড়তেই থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমাদের থেকে আরো খারাপভাবে ভুগতে হবে। কেননা তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়েই যাচ্ছে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, জলবায়ুগত সমস্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা গরিব মানুষরা। মূলত জলবায়ুগত সমস্যার জন্য দায়ী পৃথিবীর উন্নত দেশের মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ধনী মানুষেরা হয়তো অর্থ খরচ করে কিংবা প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে নিজেদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করতে পারবে কিন্তু গরিব মানুষের সে সক্ষমতা থাকবে না।

কার্বন নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় বৈশি^ক উষ্ণতা ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধরিত্রীজুড়েই দাবালন, দাবদাহ, আচমকা ঘুর্ণিঝড় ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আলোকে একটি রুলবুক বা নির্দেশনা তৈরি এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ২০২১ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে! জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে বিশ^।’ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব আজ বিশ^জুড়ে দৃশ্যমান। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর মানুষ ১০ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে। তথ্য মতে, গত ১ দশকে বরফ গলার হার ৪ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর স্থলভাগ। ফলে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে যেসব উপকূলীয় দেশ অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে সেসব দেশের প্রথম সারিতে রয়েছে বিশে^র বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রত্যেক দেশ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপকূলীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

সম্প্রতি ‘জাতিসংঘ শিশু তহবিল’ (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি শিশু। দেশের দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বসবাস করা এসব শিশুর জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকার শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে গর্ভবতী নারী ও শিশুরা অতিমাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ¦ালানির কারণে বৈশি^ক উষ্ণতার মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। বৈশি^ক উষ্ণায়নের প্রভাবে ঋতুচক্র বদলে গেছে। হিমবাহের বরফ গলছে, সমুদ্র উত্তপ্ত হচ্ছে, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত মানুষের জীবনব্যবস্থা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিব্যবস্থা, স্থানচ্যুত হয়ে মানুষ অভিবাসী বা শরণার্থীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান জলবায়ুগত সমস্যায় ঝড়ঝঞ্ঝা, খরা, বন্যা, অগ্নিকান্ডসহ বিভিন্ন ধরনের আকস্মিক দুর্যোগ আরো বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সুপেয় পানির সংকট।

যাহোক, প্রত্যেক দেশকে নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করে যেতে হবে। উন্নত দেশসমূহের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে এক কাতারে এসে আরো বেশি চাপ তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া উন্নত দেশসমূহকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নির্গমনের কমানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ¦ালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। দেশে দেশে জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জন ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। প্রতিটি শিশুর টেকসই ও উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এবং বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে উন্নত দেশসহ বিশে^র প্রতিটি দেশকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একযোগে কাজ করতে হবে। কেননা এখনই কার্যকর ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে ২০৭০ সালের পৃথিবী কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়!

লেখক : কলামিস্ট ও পরিবেশকর্মী

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close