ইয়াসমীন রীমা

  ০১ মে, ২০২৪

বিশ্লেষণ

মে দিবসের একাল-সেকাল

গ্রিক শব্দ Maius থেকে ‘মে’র উৎপত্তি। শব্দটি দেবী Maius -এর সঙ্গে সম্পর্কিত। দেবী মেইয়াকে গ্রিকরা প্রাচুর্য ও প্রবৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে মানত। মানার কারণ ছিল মে মাস হচ্ছে গ্রিকদের ফসলের মৌসুম। এ ফসলের ওপর তাদের জীবিকা নির্ভরশীল ছিল। তাই গ্রিকরা মের আগমনে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের বিশ্বাসে দেবী মেইয়াকে অভিবাদন জানাত পুষ্পমঞ্জুরি প্রদান করে।

যিশু খ্রিস্টের জন্মের বহু বছর আগে ইউরোপবাসী ঋতুরাজ বসন্তকে অভিবাদন জানাতে প্রচলন করে মে দিবস। ‘মে’কে তারা ফুলের মালা, তোড়া দিয়ে স্বাগত জানাত। আর একে অন্যের দেহে ফুলের পাপড়ি ছুড়ে শুভেচ্ছাবিনিময় করত। আবার দ্রুতরা বসন্তকে নব যৌবনের প্রতীক মনে করত। তারা মে দিবস পালন করত বৃক্ষের ছায়াতলে বন্য পরিবেশে বসে। ধারণা করা হয়, সম্ভবত তারাই ইউরোপে প্রথম মে দিবসের সূচনা করে। আবার কারও কারও মতে, মে দিবসের প্রথম সূচনা হয় মিসর বা ভারতবর্ষে।

ঊনবিংশ শতকের শ্রমিক-আন্দোলনের আগে ইউরোপের দেশে দেশে, পাড়ায় পাড়ায় পালিত হতো এ দিবস। আর তা উদযাপনে যে কত বৈচিত্র্য, কত ঘটনা ছিল, তা সংক্ষেপে বলে শেষ করা যাবে না। মে দিবস ইউরোপে বসন্তের প্রতীক হিসেবে পালিত হতে থাকে। রোমানদের কাছে ‘মে’ ছিল তাদের বছরের তৃতীয় মাস। এ সময়টায় প্রকৃতি সাজত অপরূপ সাজে। কারণ বসন্তের আগমনে চারদিকে নব পুষ্প পল্লবিত হয়ে উঠত। মৃদুমন্দ বাতাসে চারদিকে খুশির জোয়ার বইত। প্রকৃতির এ আনন্দঘন পরিবেশে ইউরোপের সর্বত্র আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত। চারদিকে কত অনুষ্ঠান, কত গান, কত নিয়মনীতি হাস্য-কৌতুকে জনপদ ভরে উঠত। তাই বলা যায়, মে দিবসের তাৎপর্য ইউরোপীয়দের কাছে ছিল এক ভিন্ন আমেজের ভিন্ন আঙ্গিকের।

ইউরোপের অন্যান্য দেশে মে দিবসের তাৎপর্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যেমন ইতালিতে শিশুরা নতুন পোশাকের মাধ্যমে মে দিবস উদযাপন করে। সুইজারল্যান্ডে ১ ‘মে’ পাইন গাছ কুমারীর জানালার কাছে রোপণ করে দিবসটি উদযাপন করা হতো। চেকোশ্লোভাকিয়ার শিশুরা মেপোল (কুমারী মেয়েকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে যে গান-বাজনা থেকে তার নাম মেপোল) তাদের জানালার ধারে রেখে অনুষ্ঠান উদযাপন করত। জার্মানরাও ইতিলিয়ানদের মতো মে দিবস জাঁকজমকসহকারে পালন করে। তবে ব্রিটিশ বা অন্যান্য দেশের মতো মার্কিনিরা কিন্তু মে দিবস পালন করে না। কিন্তু বসন্তের আগমনে অনেক আমেরিকান শহরে ছেলেমেয়ে নেচেগেয়ে বসন্তকে স্বাগত জানায়। শিশুরা হাতে তৈরি কাগজের ঝুড়িতে ফুল ভরে মের সকালে বন্ধুদের বাসায় উপহার দিয়ে আসে। ব্রিটিশরা রোমানদের থেকে মে দিবস ধার করলেও এর ইতিহাস তারা নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলে। তারা মে দিবসের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাস লিপিবন্ধ করার পাশাপাশি মে দিবস উদযাপনে বহুবৈচিত্র্য আনয়ন করে। টিউডোররা গভীর রাতে অরণ্যে গিয়ে গাছের শাখা পল্লব ফুল ইত্যাদি সংগ্রহ করে সূর্য ওঠার আগেই বাড়িতে ফিরে আসত এবং এগুলো দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি সাজাত। তারপর কুমারী একজন মেয়েকে পুষ্পপল্লবে রানি সাজানো হতো। রানিকে রাজাসনে বসিয়ে ‘রবিনহুড’ ও তার দলবল নাচে-গানে মেতে উঠত। গ্রামে গ্রামে আনন্দ গানে মাতোয়ারা হতো।

১৮৮৬ সালের ১.৩ ও ৪ মে আমেরিকার শিকাগোয় এক রক্তাক্ত ঘটনার পর ১৮৯০ থেকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সিদ্ধান্তক্রমে সারা বিশ্বে প্রতি বছর মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। হে মার্কেটে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী ঘটনার মধ্য দিয়ে আদায় হয়েছিল শ্রমিক অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষের ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবি। সারা বিশ্বে যদিও দিবসটি ঐতিহাসিক মে দিবস হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে।

প্রতি মে দিবসে অনিবার্যভাবে উঠে আসছে শ্রমিকের মজুরি ও নিরাপত্তার কথা। মজুরির একটি জাতীয় মানদ- নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি। শুধু শ্রমিকদের জন্যই এই মানদ- নির্ধারণ জরুরি নয়। দারিদ্র্যবিমোচনসহ সরকারের অসংখ্য কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে মজুরির মানদ-ের ওপর। দারিদ্র্যবিমোচনে কর্মসংস্থানের ভূমিকা সবচেয়ে প্রধান এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আমাদের দেশে একজন মানুষ যখন কর্ম খুঁজে পায়, তখন তার পুরো পরিবার সেই কর্মের আবর্তে নির্ভরতা খোঁজে। কিন্তু সেই মানুষটির উপার্জন যখন এমন হয় যে, সে নিজেই দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে পারছেন না, তখন সে এবং তার পরিবার গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়। যে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল একটি কাজ পেলে সন্তানের চিকিৎসার জন্য আর চিন্তা করতে হবে না, সন্তানকে স্কুলে পাঠাবে সেই মানুষটিই যখন সন্তানকে একটি ঝুড়ি কিনে দিয়ে মুটের কাজে পাঠাচ্ছে, তখন সরকারে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি তখন অবশ্যই ধাক্কা খায়। বর্তমানে দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি, যাদের আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে মজুরি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ মজুরি সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমার নিম্নে।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে শ্রম আইনের আওতায় রয়েছে ২০ শতাংশেরও কম শ্রমিক। মালিকের বৈরী মনোভাব, শ্রম আইনের দুর্বলতা, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দুর্বলতা ট্রেড ইউনিয়েনে দুর্বলতা, প্রভৃতি কারণে ওই ২০ ভাগ শ্রমিকও বিদ্যমান শ্রম আইনের সুরক্ষা পান না। মজুরির বিনিময়ে কাজ করে এমন শ্রমিকের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত আছে। অনেকের ক্ষেত্রে এই নির্ধারণের বয়স ১১ বছর, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৪ বছরও পার হয়ে গেছে। আবার এর চেয়েও নির্মম সত্য হলো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকের মজুরির কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণই নির্ধারিত নেই। মালিকরা সেখানে ইচ্ছেমতো মজুরি প্রদান করে। লাখ লাখ নারী-পুরুষ নির্মাণ খাতে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত। তা ছাড়া উল্লেখ করা যায় চিংড়িশিল্প, জাহাজভাঙাসহ অনেক সেক্টরে অসংখ্য ধরনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের কথা। তাদের জন্য নেই নির্দিষ্ট কোনো মজুরি কাঠামো, কর্মঘণ্টা, ছুটি বা অন্য সুযোগ-সুবিধা। তারা জানে না তাদের মজুরি কত হওয়া উচিত, কত চাওয়া উচিত, কত পাওয়া উচিত। তাদের কাছে সাপ্তাহিক ছুটি মানে এক দিন না খেয়ে থাকা। কারণ, বেতনপ্রাপ্তিসহ কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই তাদের জীবনে। ন্যায্য মজুরি না পেলে বা মজুরিই আদৌ না পেলে, ছুটি না পেলে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হলে তাদের নালিশ করার কোনো অবস্থান নেই। অনেক ক্ষেত্রে আইন তাদের নালিশ করার অধিকার দেয়নি। আবার দেখা যায় স্থানীয় পর্যায়ে কোনো নির্দিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ নেই, যেখানে এই অসহায় শ্রমিক যেতে পারে।

মূলত শিল্প ও কৃষি ছাড়াও এ দেশে বিভিন্ন পেশার মানুষ শ্রমনির্ভর। যেমন কুটিরশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক, পোশাকশিল্পের অসংখ্য নারীসহ পুরুষ শ্রমিক, ফুটপাতের ক্ষুদ্র পুঁজির মূলত শ্রমনির্ভর দোকানদার, ফেরিওয়ালা, হকার-তাদের শ্রম ক্ষেত্রগুলোতে বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান। ১৯১৬ সালে ‘ভার্সাই চুক্তি’ অনুযায়ী লীগ অব নেশন্সের সঙ্গে শ্রমিকদের মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা করবে, এর নাম হচ্ছে আইএলও বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’। পরে লীগ অব নেশন্স বিলুপ্ত হয়ে গেলেও আইএলওটিকে যায়। একটি বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠান আইএলও বা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাই সর্বপ্রথম ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়। প্রাথমিকভাবে ৪৫টি দেশ এর সদস্য ছিল। বর্তমানে সদস্যসংখ্যা ১৫৭ সংখ্যায় উন্নীত হয়েছে। ১৯৪৪ সালে (ফিলাডেফিয়া) সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নতুন করে বিশ্লেষণে এক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে তা বলবৎ আছে।

এসব চুক্তি ও সুপারিশ কার্যকর করা সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে, সে জন্য প্রত্যেক সদস্যরাষ্ট্রই নিজ নিজ দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সেগুলো পেশ করে। চুক্তিসমূহের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত ৫ হাজার আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে এসব চুক্তির প্রয়োগ যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় সে জন্য এক তদারক পদ্ধতিরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারণ শ্রমসংস্থার ত্রিপক্ষীয় কমিটি কর্তৃক পরীক্ষা-নরীক্ষা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজস্ব বিশেষজ্ঞ দ্বারা সরেজমিনে মূল্যায়নের স্বার্থেই এমন পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত আইএলওর ৩৭টি কনভেশন অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এটাই সুস্পষ্টভাবে অনুমিত যে, এখানকার দিনমজুর, শ্রমিক ও পেশাজীবীর অধিকাংশই তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। এমনকি আইএলও চুক্তিগুলোর সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতনতার সঙ্গে দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতেও হয়েছে তারা ব্যর্থ। এর জন্য দায়ী শ্রমিক নেতাদের বহুবিধ ত্রুটি ও অজ্ঞতা। ফলে সর্বব্যাপী তারা অবহেলিত বঞ্চিত শোষিত এবং নির্যাতিত। দেশের উন্নতি ও উন্নয়নে শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে উৎপাদন ও উন্নয়ন দুটিরই ব্যাহত হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close