তানভীর সালেহীন ইমন

  ০১ মে, ২০২৪

মতামত

বঙ্গবন্ধুর শ্রমদর্শন

সভ্যতার স্তরে স্তরে শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনার আর্তনাদের বিষাক্ত বাতাসে বিক্ষত হয়েছে মানবাত্মা। ‘মানবের তরে মাটির পৃথিবী দানবের তরে নয়’ এই সত্যবিশ্বাসী বলিষ্ঠ ভূমিকায় কালজয়ী কিছু মানুষ বিনির্মাণ করেছেন সভ্যতার অগ্রসরতার গতিপথ।

এ বঙ্গীয় বদ্বীপের শতাব্দীশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রনিনাদ কণ্ঠস্বর ছিল সারা বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির স্পন্দন। মানচিত্রের সীমারেখা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ববন্ধু। ১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন ‘বিশ্ব আজ দুটি শিবিরে বিভক্ত, একদিকে শাসক, আরেকদিকে শোষিত। আমি শোষিত মানুষের পক্ষে।’

কাল মার্কস বহু আগেই বলে গিয়েছেন মানবজাতির ইতিহাস মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। রাষ্ট্রের ভিত্তিকাঠামো উপরিকাঠামোকে টিকিয়ে রাখে। ভিত্তিকাঠামো যদি হয় অর্থনীতি, এর প্রাণ শ্রমজীবীদের ত্যাগ-তিতিক্ষা পরিশ্রমের অবদান।

ইতিহাস সাক্ষী, সভ্যতার বিনির্মাণ যাদের হাতে, সেই শ্রমজীবীরা হয়েছেন অবহেলিত-উপেক্ষিত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আর মালিক শ্রেণি একদিকে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়, অন্যদিকে শ্রমজীবীদের বুকের পাঁজর শুকিয়েছে অভাবে আর অবহেলায়। সম্পদের অসম বণ্টনে একদিকে ধনিক শ্রেণির বিলাসী জীবন আর অন্যদিকে ক্ষুধার্ত শ্রমিকের শূন্য পাকস্থলী! বৈষম্য আর বঞ্চনায় বিপ্লব হয়েছে অনিবার্য।

একদিকে ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, অন্যদিকে ১৬/১৭ শ্রমঘণ্টায় যন্ত্রমানবে পরিণত হয়েছিল শ্রমিক। কয়লাখনির ক্লান্ত শ্রমিকও দিনশেষে প্রিয়ার চোখে কাজলচুমো এঁকে সন্ধ্যা নামাতে চান। শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক অবিচার তাদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে, যার স্ফূরণ ঘটে ১৮৮৬ সালের ১ মে। আন্দোলন দমনের নামে গুলি করে হত্যা করা হয় ৬ শ্রমিককে ৩ মে। শ্রমিক সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণ করা হয়, গুলিবিদ্ধ ও আহত হন অনেক শ্রমিক। আগস্ট স্পাইস নামে এক শ্রমিক নেতাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কারাগারে আত্মহত্যা করেন এক শ্রমিক। শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে যায় বহুদেশে। ইতিমধ্যে ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষপূর্তি এবং রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্ব রাজনীতিতে শ্রমিকদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

১৯১৫ সালে প্রথম উরুগুযে ৮ ঘণ্টা শ্রমঘণ্টা অনুমোদন করে। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকের অধিকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেই বঙ্গবন্ধু শ্রমজীবীদের নিয়ে ভেবেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন, নিজে আত্মত্যাগ করেছেন। কিশোর বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধু মেহনতি মানুষের পক্ষে নিজের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে সঙ্গে থাকতেন। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী চব্বিশ বছর শোষণ-লুণ্ঠন-নিপীড়ন ও নিষ্পেষণ করেছে আমাদের। এই ভূখণ্ডে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করেনি। বঙ্গবন্ধু তার দুরদর্শী নেতৃত্বে শ্রমিকদের সংগঠিত করেন।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলেও বঙ্গবন্ধু তার মতো করেই বাঙালির স্বাধীনতার জন্য শ্রমিকদের মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। আদমজী নগরে শ্রমিকদের বৃহৎ সমাবেশে বঙ্গবন্ধু অংশ নেন। ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স অন ফাদার অব দ্য নেশন শেখ মুজিবুর রহমান’র চতুর্থ খণ্ডে ২ মে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ‘শেখ মুজিবুর রহমান মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে ১৮৮৬ সালে শ্রমিকরা যে জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন, তা হাসিলে সংঘটিত আন্দোলনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন’। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে আদমজী জুট মিলে বাঙালি-অবাঙালি শ্রমিকদের দাঙ্গা শান্ত করতে বঙ্গবন্ধু ছুটে যান সশরীরে। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে বঙ্গবন্ধু চীনে শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে সেই দেশের শ্রমিকদের সঙ্গে আমাদের শ্রমিকদের জীবনধারার পার্থক্য ও দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করেন।

বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণায় শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ছয় দফা বাস্তবায়নে শ্রমজীবীদের সম্পৃক্ত করতে বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে ৬৯-এর গণ-আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ব্যালটবিপ্লবে ভূমিকা রাখেন।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনে রাজপথ প্রকম্পিত করার পাশাপাশি ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্সের জনসভায় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক অংশ নেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারীদের বড় অংশ ছিল শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধেও শ্রমজীবীরা বড় সংখ্যায় অংশ নেন।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এই উর্বর মৃত্তিকার সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতার স্বপ্নের মুক্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা। তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের ভিত্তি স্থাপন করেন শ্রমজীবীদের নির্ভরতার হাত দিয়েই।

বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক, মজুর ও দুঃখী মানুষের সব দুঃখের অবসান হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ওই জমির শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়িতে চলি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন। ওরাই মালিক।’

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ছিল প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক হবে জনগণ। সে আলোকেই স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মধ্যেই তিনি বিশ্বনন্দিত শাসনতন্ত্র উপহার দেন বাঙালি জাতিকে।

বাঙালির ভবিষ্যৎ রূপরেখার সর্বোচ্চ আইনে বঙ্গবন্ধু শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা সন্নিবেশিত করেন। সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি, ১৫(খ) অনুচ্ছেদে কর্ম ও মজুরির অধিকার নিশ্চিত করা, ৩৪ নম্বর অনুচ্ছেদে সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ, ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম শ্রমনীতি ঘোষণা করেন। শিল্প-কারখানা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের মাধ্যমে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করেন। ইজারাদারি প্রথা ও ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। ১৯৭৩ সালে শিল্প শ্রমিক মজুরি কমিশন গঠন করেন। বিভিন্ন সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শ্রম পরিদপ্তর পুনর্গঠন করেন। নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭৫ সালে ২১ সদস্যের শ্রম উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিজের সুস্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেন। ১৯৭২ সালেই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ।

পরিবর্তনের পথপরিক্রমায অশ্বযানের জায়গায় এসেছে যন্ত্রযান, অরণ্যে আজ আলোকিত জনপদ। পদ্মার প্রবহমান জলধারা থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরের জলস্রোত আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। আমরা এখন মার্শাল ম্যাকলুহানের বিশ্ব পল্লীর বাসিন্দা, বিশ্বায়নের এই বাস্তবতাতেও শ্রমিকের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণের সংগ্রাম এখনো অসমাপ্ত।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সারা বিশ্বের বঞ্চিত ও মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর। নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি নেতৃত্ব দেন। দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল ১৯৭৫ সালের ১৫ ইতিহাসের নির্মম নৃশংস ও পাশবিক হত্যাকাণ্ড চালায়। এই অল্প কদিনের মধ্যেই শ্রমজীবীদের অধিকার রক্ষা ও তাদের উন্নত জীবনের জন্য বঙ্গবন্ধু যে অনন্য অবদান রেখেছেন, তা বিশ্বে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

১৯৭২ সালের ১ মে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে শ্রমিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমার গরিব শ্রমিক ভাই ও বোনেরা, আমাদের পরিশ্রম করতে হবে, উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। দেশের সম্পদ বাড়িয়ে আমরা জীবনযাত্রার প্রকৃত মান উন্নয়ন করলে সফল হবে। এ দেশের চাষি-তাঁতি, কামার-কুমোর, শ্রমিক ও মজলুম জনতার জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা কাজ করব।’

বঙ্গবন্ধুর এই শ্রমদর্শন যুগ থেকে যুগান্তর, শতাব্দীর পর শতাব্দী সব শ্রমজীবী মানুষের শানিত ও অনুপ্রাণিত হওয়ার শক্তি, সাহস, মনোবল ও প্রত্যয়।

লেখক : সাবেক জাতীয় বিতার্কিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close