মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

  ১৪ জুন, ২০২২

মুক্তমত

নবী মোর পরশমণি

মহান আল্লাহ রাসুলে পাকের (সা.) প্রতি মহব্বতকে ইসলামের মৌল বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সাব্যস্ত করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নিজের জান, সন্তান-সন্ততি ও জগতের সব মানুষ অপেক্ষা প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি অধিক ভালোবাসা প্রদর্শন করবে না, সে কখনোই মোমেন তথা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। ইসলামের এই আবশ্যকীয় আকিদা পৃথিবীর প্রায় আড়াই শ কোটি মুসলমান সমভাবে অন্তর থেকে ধারণ করে। তাই দুনিয়ার যেকোনো জায়গা থেকেই প্রিয় নবীর প্রতি অবমাননার খবরে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। উম্মতে মুহাম্মদি তা কোনোমতেই মেনে নিতে পারে না। যাদের কাছে যার জন্য মহামূল্যবান জীবনটাই তুচ্ছ, নগণ্য; সেই মহামানবের প্রতি কোনোরূপ কটূক্তি তারা কী করে সইবে! যারা বিশ্বাস করে- নবী মোর নুরে খোদা, তার তরে সব পয়দা, আদমের কলবেতে তারই নুরের রওশনি! ও নামে সুর ধরিয়া, পাখি যায় গান করিয়া, ওই নামে আকুল হয়ে ফুল ফোটে সোনার বরণি! চাঁদণ্ডসুরুজ গ্রহ-তারা, তারই নুরের ইশারা, নইলে যে অন্ধকারে ডুবিত এই ধরণী! সেই মহামানবের প্রতি তার অনুসারীদের আনুগত্য ও মহব্বতের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে আঘাত করলে; তাদের পরম প্রিয় ভরসার স্থলকে মিথ্যে অপবাদে ঢেকে দিতে চাইলে; তাদের অনুসরণীয়, অনুকরণীয় মহান আদর্শকে হেয়প্রতিপন্ন করার অপপ্রয়াস চালালে এই পৃথিবীর শান্তি-স্বস্তিই বরং মারাত্মক হুমকিতে পড়বে- এই অমোঘ বিষয়টি কারো অজানা থাকার কথা নয়।

মহান আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় নবীকে বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। রাসুলে পাকের পুরো জীবন ও কর্মকে বিশ্নেষণ করলে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই রহমত তথা তাবৎ সৃষ্টির জন্য তাকে এক করুণার প্রতীক হিসেবে দেখতে পাই। শিশু-কিশোর, যুবক ও পরিণত বয়সের সব মানুষের জন্য তিনি অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন। পৃথিবীতে বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততার নজির তিনিই স্থাপন করেছেন। জাতি-ধর্মণ্ডবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কন্যা, বধূ ও মা হিসেবে নারীর প্রকৃত মর্যাদা ও আভিজাত্য তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন। শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার প্রাপ্য মজুরি প্রদানে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী সিদ্দিক, শহীদ ও সৎলোকদের সঙ্গে থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্ধকার যুগের সব কুসংস্কার তিনিই নির্মূল করেছেন। মানবতার আর্তনাদে তিনিই সাড়া দিয়েছেন এবং যার যার হক তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত রেখেছেন। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক অবস্থান, সামাজিক মেলামেশা, রাজনৈতিক বাস্তবতা, আন্তর্জাতিক পরিকল্পনায় সব ধরনের পথনির্দেশ তিনি বাতলে দিয়েছেন। ঘরোয়া কাজকর্ম, মানুষের সঙ্গে আচার-ব্যবহার, অপরাপর জীবজন্তুর সঙ্গে করণীয়, বৃক্ষসহ যাবতীয় জীব ও জড়পদার্থের সঙ্গে গৃহীত নীতিমালা- এসবের কোনো কিছুই তার নির্ধারিত জীবনদর্শনের বাইরে থেকে যায়নি। যুদ্ধনীতি, বন্দিনীতি কী হবে, সে বিষয়েও তার রয়েছে অত্যন্ত প্রাজ্ঞজনোচিত বিধান। জীবনের কোনো একটা বিষয়ও এমন নেই, যেখানে তিনি কথা বলেননি; বাণী রেখে যাননি অথবা দিকনির্দেশনা বাতলে দেননি। শিশু হিসেবে, কিশোর বয়সে, যৌবনের সময়ে, স্বামীর পরিচয়ে, বাবার ভূমিকায় সর্বোপরি একজন পরিপূর্ণ মানুষের দৃষ্টান্ত স্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি পৃথিবীতে সর্বোত্তম।

মহানবী (সা.) সমাজে মহাসত্যের দাওয়াত দিয়েছেন। ফুলেল সংবর্ধনা পাননি; অত্যাচারিত হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের অবস্থায় পড়েছেন; জন্মস্থান থেকে বিতাড়িত হয়েছেন; গভীর ষড়যন্ত্রের মুখে পড়েছেন; শারীরিক-মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন- এসব মোকাবিলায় কাউকে কটু কথা বলেননি, গালমন্দ করেননি, অভিশাপ দেননি। বরং চরম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা বহন করেছেন। যারা তাকে মেরেছে, নির্যাতন করেছে; তিনি তাদের শুভবুদ্ধি, জ্ঞান ও হেদায়েতের জন্য মহান রব সমীপে আরজ করেছেন, প্রার্থনা করেছেন। তাকে ভয়াবহ অত্যাচার করলেও তিনি অত্যাচারীর জন্য ক্ষমার নজরানা পেশ করেছেন। উদারতা, মহানুভবতা, মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার সব দিক থেকে তিনি হলেন সবার মধ্যে আদর্শস্থানীয়, সর্বশ্রেষ্ঠ। সামাজিকতা, বিয়ে-শাদি, পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষণের ক্ষেত্রে তার চেয়ে অধিক সংবেদনশীল মানুষ মানবেতিহাসে আর নেই। সেজন্যই মুসলিমণ্ডঅমুসলিম নির্বিশেষে বিশ্ব ইতিহাসের সব মানুষ তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ; তাকে মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

ঢাকার কেরানীগঞ্জের রসুলপুর গ্রামে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন সিরাজুল ইসলাম। কবি, গীতিকার ও দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তিনি অনেকটাই অপরিচিত। কিন্তু আপন প্রতিভার আলোকে রসুলপুরের এই কৃতী সন্তান বিশ্বমানবতার মহানবীকে (সা.) নিয়ে যে বিখ্যাত নাতে রাসুল রচনা করে গেছেন, তা ঠিকই আমাদের সংগীত ভুবনে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। সেই নাতে রাসুলে কবি বলেছেন, ‘নবী মোর পরশমণি, নবী মোর সোনার খনি, নবী নাম জপে যেজন সেই তো দোজাহানের ধনী’- এই বহুল পঠিত ও পরিবেশিত ইসলামি সংগীতের প্রথম বেইতটিকেই আজকের লেখার শিরোনাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নাতের প্রতিটি চরণে নবী-ভক্তির পরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নাতের প্রতিটি কথাই ইসলামের মৌল বিষয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। বাংলা সাহিত্যে কবি নজরুলের পর ইসলামি সংগীতের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান-গজলের রচয়িতা হলেন সিরাজুল ইসলাম।

মরহুম পীরে কামেল নানার কাছ থেকে শুনেছিলাম, নিজ ধর্মের প্রতি আনুগত্য আর অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করতে পারলেই সমাজে চমৎকার আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি বিরাজ করবে- সুস্থ ও নিরাময় এক পৃথিবীর জন্য যা আজ খুবই অপরিহার্য। পৃথিবীর সব মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যে মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছিল; কিছু মানুষ আজ তাকেই অসম্মান করে যাচ্ছে। তারই অধিকার নষ্ট করছে। বস্তুত আমাদের নানা কমজুরি আর ব্যর্থতাও এ অবস্থার জন্য কম দায়ী নয়। যাবতীয় উগ্রপন্থা পরিহার করে সবার মধ্যেই পূর্ণ সহনশীলতা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ক্ষেত্রটি প্রসারিত করা আজ সময়ের দাবি; তবেই বনি আদমের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত থাকবে। আমরা ভালোবাসি আমাদের প্রিয় নবীকে, যিনি সিরাজুল হকের ভাষায় আমাদের পরশমণি; নিদানে আখেরাতে, তরাইতে পুলসিরাতে, কাণ্ডারি হইয়া নবী পার করিবেন সেই তরণী।

লেখক : চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close