শামীম মাহমুদ
মুক্তমত
যে কারণে ‘জুলাই বিপ্লব’ ইতিহাসে ব্যতিক্রম
সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে জুন মাসে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল শুধু ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতার আন্দোলন। কিন্তু পৃথিবীর আর সব স্বৈরাচারের মতো শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে মেনে নিতে গড়িমসি করে সরকার। কেননা পৃথিবীর সব স্বৈরাচারই যেকোনো আন্দোলন দমন করতে চায় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। যাতে ভয় এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করা যায়। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার যেহেতু অভ্যন্তরীণভাবে তেমন কোনো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। যতটা পড়েছিল তা বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের পর অনেকটা কেটে গিয়েছিল। গত নির্বাচনের আগে পশ্চিমা দেশগুলো ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করলেও নির্বাচনের পর সে চাপও কমে গিয়েছিল। মোটামুটি সবাই নিশ্চিত ছিল আওয়ামী লীগ সরকার নির্বিঘ্নে আগামী পাঁচ বছর কাটিয়ে দেবে। ফলে আওয়ামী লীগের মধ্যে তৈরি হয়েছিল ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। ফলে বিরোধী দল ও মতের মতো শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলন দমনে বেছে নেয় পেশিশক্তির ব্যবহার এবং আন্দোলন ভিন্নদিকে নিতে ব্যবহার করে পুরোনো কৌশল ট্যাগিং কালচার। কিন্তু কার্যত এবার আওয়ামী লীগের পুরোনো দুটি অস্ত্রই ব্যর্থ হয়।
মূলত পুলিশের গুলিতে নিহত রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু এ আন্দোলনে ক্লাইমেক্স তৈরি করে। যে বুক পেতে অপরাজিতের মতো পুলিশের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটা আন্দোলনে আবু সাঈদের মতো কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র আন্দোলনকে আরো বেগবান করে। উদাহরণ হিসেবে আমরা আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে আসাদের মৃত্যু কিংবা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের মৃত্যুর কথা বলতে পারি। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর রাতারাতি পাল্টে যায় আন্দোলনের দৃশ্যপট। মুহূর্তেই আন্দোলন রূপ নেয় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে।
ইতিহাসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নতুন কিছু নয়। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের ফরাসি বিপ্লব কিংবা ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লব ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সফলতম বিপ্লব। যার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের পতন হয়। এই বিপ্লবগুলো কালের সাক্ষী হয়ে স্বৈরাচারের নির্মম পতনের কথাগুলোকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মানুষও বিভিন্ন সময় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছে। যেমন : ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন অথবা নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু এতসব সফলতম আন্দোলনগুলোর মধ্যেও এ আন্দোলন ছিল অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
প্রথমত যে বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের কথাগুলো বললাম, সবগুলোই ছিল কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির নেতৃত্বে। যেমন : রুশ বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল লেনিনের বলশেভিক পার্টি, ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমিনী অথবা আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল একদল অরাজনৈতিক তরুণ শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ তথা পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু একদল শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে এত বড় বিপ্লব বিরল। যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছে তরুণরা। এখানে সত্যিই অবাক করার মতো, আন্দোলনের শুরু থেকে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি দিচ্ছে এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্যগত শিশুর মতো সে কর্মসূচিতে সংহতি এবং কিছু ক্ষেত্রে অংশগ্রহণও করেছে। এই বিপ্লব ইতিহাসে নতুন এক পথ তৈরি করল, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো গৌণ ভূমিকা পালন করেছে। তাই এই বিপ্লবের পুরো কৃতিত্ব শিক্ষার্থী ও জনতার। যাদের উদ্দেশ্যও ছিল মহৎ। কেননা তারা শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই পরিবর্তন চাননি। বরং তারা রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনই নয়, এই তরুণরা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কথা বলছেন। যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারা ও সংস্কৃতির একটি বড় পরিবর্তনের প্রত্যাশা এখন সবার মুখে মুখে।
দ্বিতীয়ত, এ আন্দোলনে স্থায়িত্বকাল ছিল এক মাসের মতো, অথচ অনেক বেশি রক্তাক্ত। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত অল্পসময়ে এত রক্তক্ষয়ী বিপ্লব আর দেখা যায়নি, যা এ বিপ্লবকে আর সব বিপ্লব থেকে ইতিহাসে ব্যতিক্রম হিসেবে জায়গা দিয়েছে।
তৃতীয়ত, এ বিপ্লবটি শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে এখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব পেশার, সব লিঙ্গের মানুষের অন্তর্ভুক্তি এই বিপ্লবটিকে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। রাজনীতিবিশেষজ্ঞ বদরুদ্দীন ওমর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এত বড় গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশে আগে কখনো হয়নি। এই গণ-অভ্যুত্থান অল্প সময়ের মধ্যে শহর থেকে গ্রাম তথা সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এই বিপ্লব ছিল জনক্ষোভের এক বহিঃপ্রকাশ। আর প্রত্যেকটা জনক্ষোভ থেকে এক একটা বিপ্লব হয়। ইতিহাসের প্রতিটা স্বৈরশাসকের পতন আমাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নির্মম পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের ভয়াবহ চর্চা হয়, যা শেষ হয় জনবিপ্লবের মাধ্যমে। কিন্তু তার পরও প্রতিনিয়ত শাসকরা গণতান্ত্রিক হওয়ার থেকে স্বৈরতান্ত্রিক হওয়ার দিকেই অধিকতর নজর দেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্ল মার্ক্স যথার্থই বলেছেন- এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে ইতিহাস থেকে কেউই শিক্ষাগ্রহণ করে না।
লেখক : রাজনীতিবিশ্লেষক
"