বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী

  ১৮ এপ্রিল, ২০২২

দূরে কোথাও

মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি ও মণ্ডা

মুক্তাগাছা পৌরসভার সামনে টেম্পো স্ট্যান্ডে নেমে বাজারের অজস্র মানুষের ভিড় এড়িয়ে হেঁটে হেঁটে মহারাজা সড়কে এসে প্রাচীনতার এক গভীর আবেশ অনুভব করতে লাগলাম। স্থানীয় কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগিয়ে গেলাম; উদ্দেশ্য মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি দেখা ও ঐতিহ্যবাহী মণ্ডার স্বাদ নেওয়া। সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে মূল গেট পেয়ে গেলাম, এরপর মাঠ পেরোতেই চোখের সামনে ধরা দিল ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে খানিকটা ভাবনায় পেয়ে বসল। এ দেশ থেকে জমিদারি প্রথার বিলোপ হয়েছে অনেক আগেই। একসময়ের প্রতাপশালী সেসব জমিদারের বংশধররাও অনেকেই এখন আর সেই প্রতাপ তেমন একটা রাখেন না। তবে জমিদারদের নির্মিত অনেক মূল্যবান স্থাপনা আজও মানুষকে মনে করিয়ে দেয় তাদের প্রভাব আর প্রতিপত্তির ইতিহাস। তেমনই এক স্থাপনা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার এই প্রাচীন জমিদার বাড়ি যা একটি অপূর্ব নিদর্শন। মুক্তাগাছার তদানীন্তন জমিদার ব্রিটিশ রাজন্য কর্তৃক প্রথমে রাজা এবং পরে মহারাজা উপাধি পেয়েছিলেন বিধায় জমিদারের বাসভবন রাজবাড়ী হিসেবে আখ্যায়িত হতো। এখানে বিবির ঘর ছাড়াও বিশাল আকারের পুকুর বিষ্ণুসাগর, প্রাচীন স্থাপনা যুগল মন্দির, চাঁন খার মসজিদ, সাত ঘাটের পুকুর, জলটং, রসুলপুর বনসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্পট রয়েছে। এ ছাড়াও জমিদারবাড়ির দেয়ালের প্রাচীন কারুকাজ ও চিত্রকর্মগুলো মুগ্ধতা ছড়ায়। মুক্তাগাছার জমিদারবাড়িতে একটি সুড়ঙ্গপথ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এই সুড়ঙ্গপথেই গোপনে ময়মনসিংহের শশী লজে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। উল্লেখ্য, শশী লজের এক স্নানঘরে এই রকম একটি সুড়ঙ্গপথ পাওয়া যায়।

ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায়, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নানা কারণে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর ৪ ছেলে বগুড়া থেকে আলাপসিং-এ এসে বসবাসের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর ৪ ছেলে হচ্ছে রামরাম, হররাম, বিষ্ণুরাম ও শিবরাম। বসতি স্থাপনের আগে তারা এ পরগনার বিভিন্ন স্থান ঘুরে ফিরে দেখেন এবং বর্তমান মুক্তাগাছা এলাকায় বসতি স্থাপনের জন্য মনস্থির করেন। সেসময়ে আলাপসিং পরগনায় খুব একটা জনবসতি ছিল না। চারদিকে ছিল অরণ্য আর জলাভূমি। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্যরে ৪ ছেলে ব্রহ্মপূত্র নদের শাখা নদী আয়মানের তীরবর্তী স্থানে নৌকা ভিড়িয়ে ছিলেন। সতেরশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ করা হয় মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি। ১৮০০ শতাব্দীতে ভূমিকম্পে বাড়িটি ভেঙে পড়লে ইংল্যান্ড থেকে কারিগর এনে ভূমিকম্পসহিষ্ণু করে পুনর্নির্মাণ করা হয় জমিদারবাড়িটি। মুক্তাগাছার জমিদারির মোট অংশ ১৬টি। ১৬ জন জমিদার এখানে শাসন করতেন। মুক্তাগাছা রাজবাড়িটির প্রবেশমুখে রয়েছে বিশাল ফটক। প্রায় ১০০ একর জায়গার ওপর নির্মিত এই রাজবাড়িটি প্রাচীন স্থাপনাশৈলীর অনন্য নিদর্শন। ১৯৪৭ সালের পর মুক্তাগাছার জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর ১৬ জন বংশধরের প্রায় সবাই চলে যান ভারতে। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে তাদের নির্মিত ১৬টি বাড়ি। ক্রমান্বয়ে এই বাড়িগুলোতে (প্রধান বাড়ি ব্যতীত) গড়ে তোলা হয় শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নবারুণ বিদ্যানিকেতনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

জমিদারবাড়ি দেখে ফেরার পথে চোখে পড়ল মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী ও প্রসিদ্ধ গোপাল পালের মণ্ডার দোকান। দোকানে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম এর প্রতিষ্ঠাতার কাঠের প্রাচীন প্রতিকৃতি, বংশানুক্রমিক, নানা বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রশংসাপত্র ও ছবি। কথা প্রসঙ্গে জানতে পেলাম জমিদার বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তাগাছার মণ্ডা। গোপাল পাল ১২৩১ বঙ্গাব্দে (১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ) এই মিষ্টি প্রথম তৈরি করে মুক্তাগাছার তখনকার প্রধান জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর নিকট পেশ করেন। এই মণ্ডা এতই সুস্বাদু ছিল যে, জমিদারদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের মণ্ডা দিয়েই আপ্যায়ন করা হতো। জনশ্রুতি আছে, সেসময় জমিদারবাড়ির হাতিকেও এই মণ্ডা খাওয়ানো হতো।

কথিত আছে স্বপ্নে এক সাধু গোপাল পালকে মণ্ডা তৈরির কলাকৌশল শেখান। গোপাল পালের বংশধররা এই মণ্ডার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। এই ঐতিহ্যবাহী মণ্ডা আসলে এক প্রকার সন্দেশ। দুধের ছানা ও চিনি দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। মণ্ডা প্রস্তুতকারক কারিগররাই জানেন এর পদ্ধতি সম্পর্কে। এ মণ্ডা খেয়ে তৎকালীন রাজা-জমিদাররা নানাভাবে গোপাল পালকে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত করেছেন। এমনকি উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এ মণ্ডার খ্যাতি। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত অনেক ব্যক্তি মুক্তাগাছার মণ্ডা খেয়ে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। গোপাল পালের দোকানের বর্তমান মালিক পঞ্চম বংশধর শ্রী রমেন্দ্রনাথ পাল মৃত্যুবরণ করায় ছোট ভাই শ্রী রবীন্দ্রনাথ পাল তত্ত্বাবধান করেন। মুক্তাগাছা ছাড়া দেশের আর কোথাও এই মণ্ডা তৈরি হয় না। বর্তমানে প্রতি কেজি মণ্ডা ৫৬০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। এক কেজিতে ২০ পিস হয়। প্রতি পিসের দাম নেওয়া হয় ২৮ টাকা করে। মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী মণ্ডার প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পাল না ফেরার দেশে চলে গেলেও রেখে গেছেন তার বিখ্যাত স্মৃতিচিহ্ন। তাই মুক্তাগাছার ঐতিহ্য মণ্ডা এখনো জনপ্রিয় ও সুস্বাদু খাবার হিসেবে বিবেচিত হয় গোপাল পালের স্মৃতিকে স্মরণের মাধ্যমে। ফেরার পথে অসাধারণ স্বাদের দুই টুকরো মণ্ডা মুখে দিয়ে মুক্তাগাছার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতি নিয়ে চলে এলাম।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে এনা, শামীম, শৌখিন, আলম এশিয়া, নিরাপদ পরিবহনের বাসে চেপে ময়মনসিংহে চলে আসতে পারবেন, এ ক্ষেত্রে সময় লাগবে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। এসি/নন-এসিভেদে বাস ভাড়া পড়বে ১৮০-৩৭০ টাকা। চাইলে তিস্তা/মোহনগঞ্জ/যমুনা/ব্রহ্মপুত্র/হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টায় ময়মনসিংহ ভ্রমণ করতে পারবেন। শ্রেণিভেদে ১২০ থেকে ৩৬০ টাকা করে ভাড়া পড়বে। ময়মনসিংহ এসে টাঙ্গাইলগামী বাস বা লোকাল সিএনজি অটোরিকশায় করে ৪০-৫০ মিনিটে সরাসরি যাওয়া যায় মুক্তাগাছায়। মুক্তাগাছায় নেমে বাজারের ভেতর দিয়ে ১০-১৫ মিনিট হাঁটলে অথবা রিকশা বা ভ্যানে চেপে জমিদারবাড়ি ও মণ্ডার দোকানে পৌঁছে যাওয়া যাবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close