গাজী শাহনেওয়াজ

  ৩১ অক্টোবর, ২০২১

দুর্নীতির অভয়ারণ্য পিডিবিএফ

বেশি মুনাফার আশায় বিতর্কিত ব্যক্তিদের লিজিং কোম্পানিতে টাকা বিনিয়োগ করায় বিপাকে রয়েছে পল্লী দারিদ্র্যবিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফার বদলে এখন আর্থিক ক্ষতির মুখে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে স্বাস্থ্যসেবার দোহাই দিয়ে দরিদ্রদের টার্গেট করে সদস্য সংগ্রহের নামে টাকা উত্তোলন করা হলেও ওই টাকারও হদিস নেই। দরিদ্রদের স্বাবলম্বী করার নামে এভাবে টাকা লুটেপুটে খেয়েছে সাবেক ও বর্তমান ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই প্রতিষ্ঠানে টাকা খাটানোরা এখন বলে বেড়াচ্ছেন, পিডিএফ আসলে একটি দুর্নীতির আখড়া এবং মানুষ ঠকানোর ঠগী চক্র। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেই এসব অনিয়মণ্ডদুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, এই অনিয়মের ঘটনায় একজন চাকরিচ্যুত হলেও অন্যরা দিব্যি বহাল তবিয়তে আছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পিডিবিএফের অনিয়মণ্ডদুর্নীতি’ তদন্তে ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান ছিলেন সরকারের সচিব ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (প্রতিষ্ঠান) আফজাল হোসেন। জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বিস্ময়কর অনিয়ম বেরিয়ে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) চাকরিচ্যুত এবং তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দিয়েছে। এ ঘটনায় অন্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সমবায় মন্ত্রণালয় ও পিডিবিএফ কর্তৃপক্ষ।

স্বীকার করে তদন্ত কমিটির প্রধান (বর্তমান সচিব) আফজাল হোসেন বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ছিল মন্ত্রণালয় ও পিডিবিএফ কর্তৃপক্ষের। জানা মতে, সাবেক ভারপ্রাপ্ত এমডি ছাড়া সবাই চাকরিতে বহাল আছেন। কিন্তু অনিয়ম পাওয়া প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা অভিযোগে শাস্তির সুপারিশ ছিল। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংককে মানিলন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছিল মন্ত্রণালয়; সেটাও হয়নি। এ প্রসঙ্গে পিডিবিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মওদুদুর রশিদ শফদর বলেন, তদন্ত রিপোর্টে সব তথ্য আসে না। কিছু ভুলভ্রান্তি থাকে। কারণ যারা তদন্ত করেন, তারা একটা দিক দেখেন, আরেকটা দিক হয়তো তাদের চোখে নাও পড়তে পারে। তবে এখন ব্যবস্থা নিতে হলে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, কামাল উদ্দিন তালুকদার সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকার সময় এসব ঘটনা ঘটেছিল। তখন পিডিবিএফে অরাজকতা তৈরি হয়েছিল। প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও তিনি তখন ছিলেন নতুন। পরবর্তী সময়ে সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে পিডিবিএফের পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমেই নিতে হবে। কিন্তু কামাল তালুকদার তার নিজের লোকদের দিয়ে বোর্ড সাজিয়েছেন। সে চেইন এখনো ভাঙেনি। এখন ব্যবস্থা নিতে হলে বোর্ডের অনুমতি ছাড়া কঠিন।

সূত্রমতে, ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই মদন মোহন সাহা তার বেতন স্কেলের উন্নতি ঘটান। গ্রেড-২ এর বেতন স্কেল ৬৬ হাজার থেকে গ্রেড-১ এ ৭৮ হাজার টাকা বেতন স্কেল করেন। অথচ গ্রেড-১ এ উন্নীত করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী তার চাকরির ন্যূনতম মেয়াদ ২০ বছর হওয়ার কথা থাকলেও ওই সময়ে তার চাকরির বয়স হয়েছিল ১৭ বছর। চাকরি বাড়িয়ে অতিরিক্ত বেতন নিয়ে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে তদন্ত কমিটি মনে করে। কমিটি ওই টাকা সংস্থাকে ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করে ও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে মত দেয়।

তদন্তে আরেকটি সুপারিশে দেখা গেছে, এমডি মদন মোহন সাহা ও পিডিবিএফের তৎকালীন যুগ্ম পরিচালক বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (মাঠ পরিচালন) শহিদুল হক খান ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে দুজনে আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে পিডিবিএফের সহকারী পরিচালক ফাতেমা খাতুনের নামে ২ লাখ ৫০ হাজার ও পরিণীতা রায়ের নামে ২ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে দুজনই লিখিত দিয়েছেন তাদের এ বাবদ কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের মামলা পরিচালনার জন্য মাহবুব আলম নামের এক আইনজীবীকে ৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আবদুর রহমান নামের আরেক আইনজীবীকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো চেকের মুড়ি বইতে তাদের কোনো স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। আর যে চেকগুলো দেওয়া হয়েছে ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা গেছে, চেকগুলো বিয়ারার চেকের মাধ্যমে নগদায়ন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি মনে করে এই টাকা দুজনে যোগসাজশ করে আত্মসাৎ করেছেন। মদন মোহন সাহা ও শহীদুল হক খান এভাবে বড় ধরনের একটি আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন।

এ প্রসঙ্গে মদন মোহন সাহাকে মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজ পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। তবে শহীদুল হক খান বলেন, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা যদি একটি ফাইল আনতে বলেন, তাহলে সেটা অধীনস্থ কর্মকর্তা না করে পারে না। ওই সময়ে এ রকম কাহিনি ঘটেছিল। তারপরও তদন্ত প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎসহ আরো কিছু অভিযোগ আনা হয়েছিল। এসব বিষয় জানতে চেয়ে মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠির মাধ্যমে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। প্রতিটি প্রশ্নেরই তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তার ব্যাখ্যায় মন্ত্রণালয় খুশি হয়ে তাকে এসব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

এদিকে, পিডিবিএফের ৬৮তম বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত ছিল, যেসব বেসরকারি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিতে পিডিবিএফের টাকা বিনিয়োগ করা আছে, সেগুলো তুলে সরকারি ব্যাংকে রাখতে হবে। পাশাপাশি এসব অর্থ দেশের দরিদ্র মানুষের মধ্যে স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান করতে হবে। আর কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিডিবিএফের অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে না। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে পিডিবিএফের ৬৭ কোটি ৩৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় লিজিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত-সমালোচিত পি কে হালদারের মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেডে বিনিয়োগ করা হয়েছে ২৬ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার টাকা। পি কে হালদারের কোম্পানি এখন দেওলিয়া হয়ে বন্ধ। আর পি কে হালদার দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে পলাতক। এছাড়া প্রিমিয়ার লিজিং নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ৪ কোটি ৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই কোম্পানি লভ্যাংশ তো দূরের কথা, আসলই ফেরত দিতে পারছে না পিডিবিএফকে। এছাড়া এভাবে ১৫টি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পিডিবিএফের ১০০ কোটি ৪২ লাখ ৫ হাজার টাকা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছেন দায়িত্বশীলরা। এর বাইরে মিডল্যান্ড নামের একটি আনকোরা ব্যাংকে আরো ১০৪ কোটি ১৩ লাখ ২৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছে। তদন্ত কমিটি মনে করে, মদন মোহন সাহা ও শহীদুল হক খান পরস্পর যোগসাজশ করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যয়িত অর্থের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছেন। এ ঘটনার জন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তদন্ত কমিটি সুপারিশ করে।

পিডিবিএফের বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ‘সেবা নীড়’ নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল গ্রামের দরিদ্র নারী-পুরুষ ৬০০ টাকা দিয়ে সদস্য হতে পারবেন। পরবর্তী বছরের জন্য দিতে হবে ৪০০ টাকা। এভাবে ৪০৩টি কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রচুর সংখ্যক সদস্য সংগ্রহ করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৪ কোটিরও বেশি টাকা উত্তোলন করা হয়। তাদের স্বাস্থ্য সেবাদানের জন্য অ্যাডভিন লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ ৮০ হাজার ২৫০ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, এ প্রকল্পের মাধ্যমে কাউকে কোনো স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়নি। অথচ ময়মনসিংহের ভালুকা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, ঘাটাইল, বাসাইল, গোপালপুর, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, চেচুয়াবাজারসহ সারা দেশ থেকে ৪ কোটিরও বেশি টাকা দরিদ্রদের কাছ থেকে তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালে কোনো রকম নিয়মনীতি অনুসরণ না করে বিভিন্ন পদের ৭৮৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এই পদোন্নতির জন্য কোনো অনুমোদিত গ্রেডেশন তালিকা করা হয়নি।

আবার পিডিবিএফের বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠলে ওই প্রকল্পে দায়িত্ব পালনকারীদের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে ফাপাড (ফরেন এইডেড প্রজেক্ট অডিট ডিপার্টমেন্ট)। তারা দেখতে পান দায়িত্ব পালনকারী ৪৫ কর্মকর্তার পিডিবিএফে চাকরি পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই ছিল না। ফাপাডের অডিট আপত্তির পর পাঁচজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দুর্নীতি,পিডিবিএফ,স্বাস্থ্যসেবা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close