মোহাম্মদ অংকন

  ০৬ অক্টোবর, ২০১৮

বাবার আদর্শ

রাব্বি গ্রামের একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। প্রতিদিন বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে স্কুলে যায়। স্কুল ছুটি হলে আবার দল বেঁধে বাড়ি ফেরে। বিকালে পাড়ামহল্লায় খেলতে যায়। সন্ধ্যা হলে বাতি জ্বালিয়ে পড়তে বসে। এভাবেই তার প্রতিটি দিন কাটে। মাঝেমাঝে সে তার বাবার সঙ্গে গ্রামের হাটে যায়। হাট থেকে ফেরার সময় রাব্বির বাবা তাকে খাওয়ার জন্য চকলেট, রুটি ও লজেন্সসহ নানা জিনিস কিনে দেন। শুধু এসবই কিনে দেন না, প্রতিবার হাট থেকে দু-একটা করে চারাগাছও কিনে দেন। তার বাবার গাছ লাগানোর দারুণ নেশা। যেখানে একটু ফাঁকা জায়গা দেখেন, সেখানেই তিনি গাছের চারা লাগান। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে চারাগুলোকে বড় গাছ করে তোলেন। এতেই তিনি থেমে থাকেন না। কোথাও খাঁচায় বন্দি পাখি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে শিকারীদের বুঝিয়ে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। অসচেতন শিকারীরা তার কথা মানে। ‘আমরা আর পাখি শিকার করব না। আমরা বুঝতে পারিনি।’ রাব্বির বাবার এসব কাজ তার খুবই ভালো লাগে। রাব্বির বাবার মতোই অনেকটা তার মা। সে তার মাকেও দেখে, বাড়ির আশেপাশে বিভিন্ন শাক-সবজির বাগান করছেন। ঘরের সীমানায় ফুলের গাছ লাগাচ্ছেন। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসবের পরিচর্যা করছেন। এসব কাজে রাব্বির বাবা বরাবরই সমর্থন দেন স্ত্রীকে।

একদিন সকালে রাব্বি ঘুম থেকে উঠে দেখে তাদের বাড়িতে একজন ডাক্তার এসেছেন। সে ঘর থেকে বের হয়েই বুঝতে পারল, তার বাবা ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার মহোদয় তার চিকিৎসা করছেন। এমন দৃশ্য দেখে তার মনে ভয় জাগে। সারা দিন বিষণœতায় কাটে। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় কেউ কেউ বলল, ‘রাব্বী রে, তোর বাবা মনে হয় আর বেশি দিন বাঁচবেন না। তোর বাবা না থাকলে তোর অনেক কষ্ট হবে রে, তাই না?’

বন্ধুদের মুখ থেকে এমন কথা শুনে তখন সে কাঁদতে কাঁদতে তার বাবার কাছে ছুটে আসে। ‘বাবা, ওরা আামাকে এসব কথা বলছে?’

তার বাবা তাকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘ধুর পাগল, আমার কিছুই হয়নি। আমি ঠিক আছি। ওরা না বলে ওসব। দুষ্টুমি করেছে।’ এসব কথা তাকে বলতে বলতে নীল জামার পকেট থেকে কয়েকটা কয়েন বের করে রাব্বিকে দিয়ে বলেন, ‘বাজান আমার, দোকান থেকে চিপ্স-লজেন্স কিনে খেও। আর কারো সঙ্গে দুষ্টুমি কর না। সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসো।’ রাব্বি বাবার স্নেহ পেয়ে যেন আনন্দে মনটা ভরিয়ে তোলে। খেলাধুলা করতে আবার বন্ধুদের কাছে ছুটে যায়।

রাব্বিদের অভাবের সংসার। সত্যিই তার বাবা গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসা করানোর মতো পর্যাপ্ত টাকা তার বাবার নেই। কিন্তু উপায় কী এখন? রাব্বির বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, তার চিকিৎসার জন্য বাড়ির আঙিনার গাছগুলো বিক্রি করে দেওয়ার এবং তিনি ঠিক তাই করলেন। চিকিৎসার জন্য বাড়ির আঙিনার পুরনো ও নতুন গাছগুলো বিক্রি করে দেওয়া হলো। এতেও সব টাকা জোগাড় না হওয়ায় তার বাবা কয়েকজন প্রতিবেশী কাছ থেকে ঋণ নিলেন। এরপর তার বাবা শহরে গিয়ে নিজের চিকিৎসা করালেন। চিকিৎসা করানোর পরও রাব্বির বাবা কখনো সুস্থ থাকেন আবার কখনো অসুস্থ হয়ে যান। বাবার এমন অবস্থা দেখে তার মা-ও যেন দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। অভাবের সংসারে আত্মীয়-স্বজনের দেওয়া টাকায় ওষুধপত্র কিনে খেয়ে তার বাবার দিনগুলো অতিক্রম হতে থাকে। রাব্বির বাবা অসুস্থ, তারপরও তিনি গাছ লাগাতেন। আর তিনি স্বপ্ন দেখতেন, ‘এই গাছগুলো আমার ছেলের অভাবের সময় কাজে লাগবে। যেমন করে পুরাতন গাছগুলো আমার কাজে লেগেছে।’ গাছের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘তোরা বেঁচে থাক। তোরাই আমার ভবিষ্যৎ।’

বছর ঘুরে ঈদ এলো। ঈদে নতুন পোশাক নেওয়া রাব্বির কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। আর তার সে স্বপ্ন পূরণে মামারা তাকে টাকা দিলেন। টাকা দেওয়ার পর মামারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাব্বি, ঈদে নতুন জামাকাপড় কিনেছ কি?’ তখন রাব্বি ওসব কিছু না কিনেই বলল, ‘হ্যাঁ মামা, আমি সব কিনেছি।’ তার এমনটা বলার একটাই কারণ, ঘরে তার অসুস্থ বাবা রয়েছে। প্রতিদিনই ওষুধের জন্য টাকা লাগে। সে ঈদে পুরাতন পোশাক পরেই নামাজ আদায় করতে গেল। তার অসুস্থ বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সে ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়তে যায়। নামাজ শেষে বাড়িতে এসে মায়ের হাতে রান্না করা সেমাই খেয়ে দারুণ একটা ঈদের আমেজ উপভোগ করে। আর বিকেল হলেই বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে।

ঈদের দিন তার বন্ধুরা নতুন নতুন জামা-প্যান্ট ও জুতা পরে ঘুরে বেড়ায়। আর রাব্বি তার বাবার দেওয়া ১৫ থেকে ২০ টাকা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেয়। তার কোনো কোনো বন্ধু বলল, ‘কি রে রাব্বি, ঈদে কি নতুন পোশাক কিনিসনি? এই জামা-প্যান্ট তো তইি প্রতিদিনই পরিস!’ লজ্জায় রাব্বি বলল, ‘আমি আগামী ঈদে কিনব রে। প্রতি ঈদেই নতুন পোশাক কিনতে হবেÑ এমন কোনো কথা নেই। আর নতুন পোশাকের সঙ্গে ঈদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ ঠিক এভাবেই রাব্বির ঈদের দিনটা কেটে যায়। কিন্তু ঈদের রাতে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। রাব্বির বাবা পৃথিবী থেকে না ফেরার দেশে চলে যায়। তার বাবার অকাল মৃত্যুতে সে যেন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। উচ্চস্বরে কান্না করতে থাকে। সবাই তাকে সান্ত¡না দেয়। ‘দেখ রাব্বি, কারো বাবা কখনো চিরদিন বেঁচে থাকে না। একদিন আমাদেরও চলে যেতে হবে। ধৈর্য ধরো। তোমার মা তো বেঁচে আছে।’

তারপর মাসের পর মাস কেটে যায়। রাব্বি তার বাবা বেঁচে থাকার দিনগুলো প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখে। তার বাবার কথাগুলো কানে এসে ভাসে। যেন তার বাবা বলছেন, ‘খোকা, তুই আমার লাগানো গাছগুলোর পরিচর্যা করিস। যেখানে একটু ফাঁকা জায়গা দেখবি, সেখানেই গাছ লাগাবি। আর পশুপাখিকে কখনো কষ্ট দিবি না।’ রাব্বি যেন এসব ভেবে ভেবে অনুপ্রেরণা পায়। কিন্তু পারিবারিক দৈন্যতা তাকে থামিয়ে দেয়। সে চিন্তা করে, ‘কবে আমি বড় হব?’ পরক্ষণে সে ভাবে, ‘আমি বড় হলে, আমিও আমার বাবার মতো গাছপালা লাগাব। পশুপাখিকে ভালোবাসব। আমি আমার বাবার

আর্দশকে বুকে লালন করে বেঁচে থাকতে চাই। সবুজে দেশকে

ভরিয়ে দিতে চাই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close