রবিউল আলম ইভান, কুষ্টিয়া

  ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

কুষ্টিয়ায় সামাজিক বনায়ন 

আপাতত রক্ষা পাচ্ছে  ৩ সহস্রাধিক গাছ 

কুষ্টিয়ায় কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়া থেকে সান্দিয়ারা পর্যন্ত জিকে খাল ঘেঁষে বেড়ে উঠা গাছ-  ছবি প্রতিদিনের সংবাদ 

তীব্র তাপপ্রবাহের মাঝেও মানুষ প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়া থেকে সান্দিয়ারা পর্যন্ত জিকে খাল ঘেঁষে দন্ডায়মান প্রায় তিন সহস্রাধিক গাছের ছায়াশীতল পরিবেশে। তবে সেই প্রশান্তি আর বেশি সময় স্থায়ী হচ্ছে না।

সড়কে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় লাগানো মেহগনি, কড়ই, বাবলাসহ ওইসব মূল্যবান গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বনবিভাগ। এরই মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতাও শেষ করে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এ গাছগুলো আপাতত কাটা হচ্ছে না বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, যেকোনো সময় এগাছগুলো কাটা শুরু হতে পারে। এনিয়ে স্থানীয়রা ও পরিবেশবিদরা তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানালেও বনবিভাগের কর্তা ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তাদের কোনো কিছু করণীয় নেই।

জানা যায়, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর লাহিনীপাড়া থেকে সান্দিয়ারা পর্যন্ত পাউবোর জিকে খাল ঘেঁষে প্রায় ২০ কিলোমিটার রয়েছে পাকা সড়ক। সড়কে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় সমিতির মাধ্যমে প্রায় ১০ বছর আগে কয়েক হাজার ফলদ ও বনজ গাছের চারা রোপণ করে উপজেলা বনবিভাগ। এর আগেও দরপত্রের মাধ্যমে ২০২৩ সালে যদুবয়রা থেকে সান্দিয়ারা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কের আনুমানিক প্রায় ১০ হাজার গাছ কাটা পড়েছে। চলতি বছরেও ওই সড়কের লাহিনীপাড়া থেকে বাঁধবাজার পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কের প্রায় ৩ হাজার গাছ কাটা হয়।

সম্প্রতি, বাঁধবাজার থেকে মাদুলিয়া পর্যন্ত আরো তিন কিলোমিটার সড়কের কয়েক হাজার গাছ কাটার জন্য গাছে নাম্বারিং করে দরপত্র সম্পন্ন করেছেন বনবিভাগের কর্মকর্তারা। তবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য গাছগুলো না কেটে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও পথচারীরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, লাহিনীপাড়া এলাকায় সড়কের ধারে আর সবুজের নয়নাভিরাম দৃশ্য আর নেই। কাটা গাছগুলোর গোঁড়া ও কিছু অংশবিশেষ পড়ে আছে। চাঁপড়া বোর্ড অফিস এলাকার খালের পাকা ও কাঁচা সড়কের দুপাশে মেহগনি, বাবলা, কড়ইসহ নানা জাতের কয়েক হাজার বড় বড় গাছ রয়েছে। সেগুলোর গাঁয়ে নাম্বারিং করা।

স্থানীয় বাসিন্দা সাকিব জানান, তিনি নিয়মিত ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। ওই এলাকাতেই বাড়ি হওয়ায় গাছের ছায়াশীতল পরিবেশের স্নিগ্ধাতা পান তিনি নিজেও। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষও বিশ্রাম নিতে আসেন এখানে। পথচারীরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসে পড়েন এখানে। কিন্তু হঠাৎ করেই দেখলাম গাছে নাম্বার বসানো হয়েছে। স্থানীয় বনবিভাগের লোকজন এমনটি করেছে। গাছগুলো কেটে ফেলা হবে।

এপথ দিয়ে চলাচলকারীরা জানান, তীব্র তাপপ্রবাহে চলছে কুষ্টিয়ায়। গরমে কোথাও স্বস্তি নেই। সামান্য স্বস্তি পেতে মানুষ যে যার মতো পারছেন নিজেকে ঠান্ডা পরিবেশে রাখার চেষ্টা করছেন। সান্দিয়ারা সড়কের গাছগুলো মানুষের জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে। এ পথে চলাচলকরী অনেকেই এ ঠান্ডা পরিবেশে বসে জিরিয়ে নেয়। কিন্তু যখন শুনলাম গাছগুলো কেটে ফেলা হবে তখন মনটা যেন খারাপ হয়ে গেল। গাছগুলো আরো অন্তত শতবছর ছায়া দিতে পারবে। বর্তমানে যে আবহাওয়া তাতে এ গাছগুলো না কাটাই ভালো। আমরা একটু শান্তিতে চলাচল করতে পারতাম।

কুমারখালী উপজেলা বনবিভাগ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আর্থ-সামাজিক ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে ২০০৪ সাল থেকে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বনবিভাগ। তারা প্রথমে স্থানীয়দের নিয়ে এলাকাভিত্তিক সমিতি গঠন করে। পরে বিভিন্ন সড়কের ধারে জ্বালানি কাঠের গাছের চারা রোপণ করেন। গাছ দেখাশোনা করে সমিতির সদস্যরা। গাছের বয়স যখন ১০ বছর পূর্ণ হয় তখন গাছ কাটা ও বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বনবিভাগ। গাছ বিক্রির ৫৫ ভাগ টাকা পায় সমিতির সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ পায় বিক্রির টাকার ৫ ভাগ। আর বনবিভাগ ও সড়ক সংশ্লিষ্ট বিভাগ পায় ২০ ভাগ করে টাকা।

এ বিষয়ে চাপড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক মঞ্জু বলেন, সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে গাছগুলো। শুধু তাই নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে এ গাছগুলো। জেনেছি গাছগুলো কেটে ফেলা হবে। তবে আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে চেষ্টা করব গাছগুলো যাতে করে রক্ষা পায়। এ সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালীপনা।

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. রেজওয়ানুল ইসলাম জানান, সারাবিশে^ পরিবেশ বিপর্যয় নেমে এসেছে। বাংলাদেশেও পরিবেশ প্রায় বিপন্ন। মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এরই মধ্যে সরকার পরিবেশ রক্ষায় নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তার মধ্যে বৃক্ষরোপণ অন্যতম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কুমারখালীর সান্দিয়ারা সড়কে তিন সহস্রাধিক গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এটি একটি অপরাধ। তার মতে, যে কোনো বৃক্ষই কাটা যাবে না। গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই এগুলোকে রক্ষা করতে হবে। এটি আমার আপনার সকলের নৈতিক দায়িত্ব। উপজেলা বনবিভাগ কার্যালয়ের কর্মকর্তা আরিফুর রহমান জানান, ১০ বছর পূর্ণ হলেই সমিতির নিয়ম অনুসারে গাছ কেটে পুনরায় নতুন চারা রোপণ করা হয়। এরই মধ্যে ওই সড়কের ১৩ কিলোমিটার এলাকার গাছ কাটা হয়েছে। অন্য গাছগুলো দরপত্রের মাধ্যমে কাটা হবে। তার ভাষ্য, গাছ রক্ষার কোনো সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম জানান, বিষয়টি শুনেছি। গাছগুলো যাতে করে রক্ষা করা যায় সেবিষয়ে স্থানীয় বনবিভাগ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব। জনতার দাবির মুখে স্থানীয় এমপি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরব ভূমিকা রেখেছেন। সবার হস্তক্ষেপে এ গাছগুলো কাটা থেকে সাময়িকভাবে সরে এসেছে বন বিভাগ।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাশ্যপী বিকাশ চন্দ্র বলেন, ‘এটা সামাজিক বনায়নের অংশ। টেন্ডার ও ঠিকাদার নিয়োগ হওয়ার পর স্থগিত করার ক্ষমতা আমাদের নেই। বর্তমানে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের করণে আপাতত গাছ কাটা বন্ধ রাখা হয়েছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে। এ কর্মকর্তা আরো বলেন, গাছ কাটার পর সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে পুনরায় গাছ লাগানো হবে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close