জাহিদুল ইসলাম

  ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক কর্মী শোষণকেন্দ্র

না মানছে শ্রম আইন, আর না মানছে নিজস্ব চাকরিবিধি। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে (বিসিবি) বোর্ড অব ডাইরেক্টরসদের মুখের কথা দেশের আইন-কানুনেরও চেয়েও ঊর্ধ্বে। তাই তাদের কোনো নিয়মনীতি লাগে না বলেই মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির চাকরিহারা শতাধিক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। অবশ্য ব্যাংকটির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও এমনটাই জানিয়েছেন।

জানা গেছে, শ্রম আইন ও চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে গত ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১২০ জন চতুর্থ শ্রেণির স্থায়ী কর্মচারীকে চাকরি থেকে গণছাঁটাই করে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এরপর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে আবেদন করতে বলা হয়। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করে একই পদে পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করার কোনো নিয়ম নেই। তাছাড়া ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে শ্রম আইন অনুসারে ৩ মাস আগে নোটিস বা তাৎক্ষণিক ছাঁটাইয়ে ৩ মাসের বেতন পরিশোধের নিয়মও মানেনি ব্যাংকটি। দেওয়া হয়নি প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি বা শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিলের টাকা।

এ বিষয়ে বিসিবির চাকরিচ্যুত কর্মচারীরা বলেন, কোনো নোটিস না দিয়েই ঈদুল ফিতরের মাত্র দুদিন আগে (৯ এপ্রিল) বিনা অপরাধে আমাদের ১২০ জন স্থায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করে বিসিবি। হঠাৎ এই চাকরিচ্যুতির করার কারণ জানতে চাইলে তারা আমাদের মৌখিকভাবে জানায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভালো না তাই আমাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি আদৌ সত্য নয়, কারণ আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকলে মাত্র ১৫-২০ দিন আগে ব্যাংকের প্রায় সব অফিসারকে প্রমোশন দেওয়া হয় কীভাবে? এর ফলে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যাংকের ব্যয় প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা বেড়েছে। আবার যারা অফিসার থেকে অ্যাসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তাদের সবাইকে গাড়ি দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

চাকরিচ্যুত এসব কর্মচারী জানান, আমাদের ১২০ জন কর্মচারীদের পরিবারসহ প্রায় ৯২৭ জন মানুষ এই পবিত্র ঈদুল ফিতরে অর্ধাহারে-অনাহারে ছিল। প্রতিকারের জন্য সবার কাছে গিয়েছি কিন্তু কোনো সুরাহা পাইনি। আমরা আমাদের চাকরি বহালের দাবি জানাই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাঁটাইকৃত ১২০ জন কর্মচারীদের মধ্যে ৭১ জনকে এরই মধ্যে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে পুনঃনিয়োগ পেতে আবেদন করতে বাধ্য করেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। নাম প্রকাশ না করে পুনঃনিয়োগে বাধ্য হওয়া প্রতিষ্ঠানটির এক গাড়িচালক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা যেন চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে যোগদান করি, এজন্য ওপরের স্যাররা আমাদের চাপ দিয়েছেন। না হয় আমাদের ৩ মাসের বেতন, প্রভিডেন্টের টাকা ও শ্রম আইনের অন্যান্য সুবিধা বন্ধ করে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন।

মূলত শ্রমিক ছাঁটাইয়ের এই ঘটনার নেপথ্যে প্রতিষ্ঠানটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাদের জড়িত ছিলেন বলে জানিয়েছে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের একটি সূত্র। কর্মীরা জানায়, তাদের অধিকাংশেরই ওই ব্যাংকটিতে কর্মচারী লোন নেওয়া আছে। এখন চাকরি ছাঁটাই হলে তারা প্রভিডেন্ড ফান্ড ও গ্র্যাচুয়িটির টাকা থেকে বঞ্চিত হবেন। ওয়াসিফ নামে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মচারী জানান, সবাই চায় একটু ভালো থাকার জন্য। আমরা যখন ব্যাংকের নিয়মিত কর্মচারী ছিলাম তখন গ্রামে বাড়ি বানাতে ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছি। ইচ্ছা ছিল অবসর নেওয়ার আগে ধীরে ধীরে লোনের টাকা পরিশোধ করে দেব। কিন্তু এখন যে অবস্থা হয়েছে তাতে লোন পরিশোধ করতে হবে প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুয়িটির টাকা দিয়ে। ফলে আমাদের না থাকল চাকরি আর এত দিন ব্যাংকটিতে শ্রম দেওয়ার কোনো মূল্য থাকল না।

আবার আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা ৫৯ বছর থাকলেও তা না মেনে নিজেদের ইচ্ছামতো ৫৫ বছর বয়সসীমা করেছে ব্যাংকটি। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ৩৮৬তম বোর্ডসভায় চাকরির এই বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আইন অনুসারে, কোনো প্রতিষ্ঠান তখনই নিজস্ব চাকরিবিধি অনুসরণ করতে পারবে যখন সেটি শ্রম আইনে একজন শ্রমিককে দেওয়া সুবিধার বেশি সুবিধা প্রদান করতে পারবে। কিন্তু শ্রম আইনের পর্যাপ্ত সুবিধাই যেখানে বিসিবি বাস্তবায়ন করতে পারছে না, সেখানে নিজস্ব চাকরিবিধি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করার উপযুক্ততা নেই বলেই মনে করেন আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত কর্মচারীকে ছাঁটাই করে একই প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা যায় না। এক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান হলে সংক্ষুব্ধ ওই কর্মচারী ইচ্ছা করলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করবে।

তবে শ্রম বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী ড. উত্তম কুমার দাস জানান, সরকারি চাকরিতে কোনো ছাঁটাই হয় না। ছাঁটাই হলো লেবার ল’ এর একটি প্রভিশন। সরকারি চাকরিতে ডিসিপ্লিনারি প্রসিডিউরে ডিসমিসাল করতে পারে অথবা তার সার্ভিস রুল অ্যালাউ করে টার্মিনেট করতে পারে।

এদিকে আইন ভেঙে শ্রমিকদের স্থায়ী চাকরি থেকে ছাঁটাই ও প্রাপ্য সুবিধা না দিয়ে বরং তাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা গত ১৬ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করলে তাদের হয়রানির উদ্দেশ্যে এই সাধারণ ডায়েরি করা হয় বলে জানা গেছে। মানববন্ধনে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের চাকরিচ্যুত ড্রাইভার মো. মনিরুল ইসলাম, আইয়ুব, ইলেকট্রিশিয়ান আরিফ, ফারুকসহ প্রায় ২০-২৫ জন উপস্থিত ছিলেন।

আইন লঙ্ঘন করে এমন গণছাঁটাইয়ের বিষয়ে বিসিবির বক্তব্য জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজুল ইসলামের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অফিস থেকে প্রতিষ্ঠানটির হেড অব মার্কেটিং ফারুক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়। ফারুক আহমেদ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ঈদের মাত্র দুদিন আগে ১২০ জনকে নিয়মিত কর্মচারীকে ছাঁটাই খুবই বেদনাদায়ক। তবে আমরা সবাইকে ছাঁটাই করিনি, শুধু যাদের বয়স ৫৫ বছর অতিক্রম করেছে তাদের। আর বাকিদের পুনরায় নিয়োগ পেতে আবেদন করতে বলা হয়েছে। যাদের স্থায়ী চাকরি ছিল তাদের স্থায়ী চাকরি বাতিল করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা হচ্ছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত চাকরিরতদের নিয়োগ বাতিল করে পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা যায় কি না এমন প্রশ্নে বলেন, আমাদের কোনো নিয়মনীতি নেই, আমাদের বোর্ড যা বলবে সেটাই নিয়ম। বোর্ড চেয়েছে তাই তাদের চাকরি বাতিল করা হয়েছে।

এছাড়া শ্রম আইন অনুসারে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের চাকরিতে অবসর নেওয়ার বয়সসীমা ৫৯ বছর থাকলে বোর্ডসভা করে আইন ভেঙে সেটা ৫৫ বছর সীমা নির্ধারণ করার এখতিয়ার কি পরিচালনা পর্ষদ রাখে? এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি ব্যাংকটির ওই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, শ্রম আইন হলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তারা অধিকার আদায়ের জন্য যেকোনো পর্যায়েই যেতে পারে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে যদি তাদের গিভেন্স থাকে তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এফআইসিএসডিতে তারা অভিযোগ করতে পারে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইনি বিষয়সহ পুরো প্রক্রিয়াটি যাচাই-বাছাই করে দেখবে এবং সিদ্ধান্ত নেবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close