আবু বকর আরাফাত

  ২০ এপ্রিল, ২০২৪

কাঠুরের দিনপঞ্জি

স্নিগ্ধ বিকেল। সবুজের মুগ্ধতায় সুশোভিত গ্রামীণ পরিবেশ। চারপাশে বাঁশঝাড়। মাঝখানে সামান্য উঁকিঝুঁকি মেরে তাকিয়ে আছে প্রকাণ্ড এক বটগাছ। বটগাছটি প্রায়ই খুব খুশি হয়। নিজের বড়ত্বকে প্রকাশ করে বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলোকে বলতে থাকে।

: এভাবে আঁকাবাঁকা হয়ে আর কত দিন থাকবি! দেখেছিস আমার ডালপালা কত মজবুত। পাতাগুলো কত সবুজ। সূর্যের আলোতে চমকে ওঠে। আর আমার বড়ত্ব দেখে মানুষ ভয়ও পায় বটে। অনেকে তো আমাকে ভুতুড়ে গাছ মনে করে কাছেও আসে না। আমি যত বড় হই, আমার শক্তিও তত বৃদ্ধি পায়। ডালপালা মজবুত হয়। ঝড়ের মোকাবিলা করতেও সহজ হয়। আর তোরা, নিজেদের সোজা করতে গেলেই বেঁকে যাস। আর ঝড়ের কবলে পড়লে তো কোনো কথাই নাই। ভেঙে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাস। অবশ্য তোর দুটি জিনিস একটু সুন্দর। সূর্যের আলোতে তোর পাতাগুলো ঝলমল করে। আর জোছনার আলোতে এক মোহনীয় রূপ তৈরি হয়। আমি অবশ্য দেখতে তেমন সুন্দর না। তবে এসব সৌন্দর্য দিয়ে কী আর করবি? নিজের মরে যাওয়ার দিন গুনতে থাক শুধু।

বটগাছের এমন কথা শুনে বাঁশগুলোর একটু কষ্ট হলো। কিন্তু সে নিজেকে সংবরণ করে নিল। একবার চাচ্ছিল কিছু বলতে, কিন্তু কি ভেবে যেন আবার চুপ হয়ে গেল। যে গাছ নিজের বড়ত্ব ও শক্তি নিয়ে এমন অহংকার করে। এমন গাছের সঙ্গে অযথা তর্ক করার কোনো মানে হয় না।

ওই বনের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল একজন কাঠুরে। বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বেচারা নিজের জীবন রক্ষা করে। ইদানীং খুব দুর্দশার মধ্যে সময় কাটাতে হচ্ছে তাকে। ভালো কোনো গাছের সন্ধান পেলে সেখান থেকে কিছু টাকা আসে। সে টাকা দিয়ে সংসার চলে। আর যখন কোনো গাছের সন্ধান না পায়। আর কাঠ সংগ্রহ করা হয়ে উঠে না। তখনই শুরু হয় বেহাল দশা। কাঠুরের একটি ছেলে আছে। স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে অল্পতেই নিজেদের সন্তুষ্ট করে রেখেছেন তিনি। কোনো কোনো সময় এমনও আসে যে, সকালের নাশতা বানানোর জন্য ঘরে কিছু না থাকার কারণে ছেলেকে ঘুম থেকে জাগাতে পারেন না। এই দুর্দশার মধ্যে স্ত্রীও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। হঠাৎ এক দিন শহর থেকে গ্রাম পুলিশ কর্তৃক কাঠুরের কাছে একটি প্রস্তাব আসে। যদি কোনো বড়সড় গাছের কাঠ সে আনতে পারে। তাহলে অনেক বড় একটি অ্যামাউন্ট সে পাবে। সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কাঠুরে নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। গভীর বনে তিনি কোনো দিন যাননি। সে সাহস তার হয়নি। যদি কোনো হিংস্র প্রাণী আক্রমণ করে। অবশ্য তিনি শেয়াল ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী আজ পর্যন্ত এ বনে দেখেনওনি। আজ হঠাৎ কি মনে করে বনের গভীরে প্রবেশ করার ইচ্ছে করলেন। শক্ত একধরনের পোশাক পরে হাতে কাঠ সংগ্রহের জিনিসপত্র নিয়ে তিনি বনের গভীরে প্রবেশ করলেন। হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটি মেহগনিগাছ। দেখতেও খুব সুন্দর। ভালোই মোটাতজা। তিনি গাছটির সামনে গিয়ে থামলেন। চারপাশের দূর্বাঘাসগুলো হালকা করে উঠিয়ে গাছটি কাটতে লাগলেন। মেহগনিগাছ থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে করতে একসময় তিনি কিছুটা ক্লান্ত অনুভব করলেন। তারপর একটু বিশ্রামের জন্য বাঁশঝাড়ের নিচের এসে বসলেন। তখনই লক্ষ করলেন। বাঁশঝাড়ের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক বটগাছ। তিনি সেটা দেখে তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে ওঠেন।

: এই গাছটা এত দিন কোথায় ছিল, এটার কাছ থেকে তো অনেক কাঠ সংগ্রহ করা যেত।

নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকলেন। আজ যদি এই বনের গভীরে তার চোখে পড়ত, তাহলে কখনো তাদের কষ্ট করে বাঁচতে হতো না। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। কালই এখানে এসে বটগাছটা কেটে ফেলবেন। কাঠুরের এসব কথা বাঁশঝাড় ও বটগাছের কানও এড়িয়ে যেতে পারল না। তারাও মনোযোগ দিয়ে কাঠুরের আহ্লাদের কথাগুলো শুনছিল। কাঠুরের কথা শুনে বটগাছের সে কি কান্না। তার কান্না দেখে বাঁশঝাড় বলে উঠল।

: তুমি তো অনেক বড়, তাই না! বড় বলে নিজেকে নিয়ে সবসময় গর্ব করো, এখন বুঝো কেমন লাগে!

: আমাকে বাঁচাও প্লিজ, আর কখনো কোনো দিন তোমাদের সঙ্গে নিজের বড়ত্ব প্রকাশ করব না!

বটগাছকে এমন নত হতে দেখে বাঁশগুলোর মায়া হলো। পুরো বাঁশঝাড়ের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল। যেভাবেই হোক বটগাছটা তারা কাটতে দেবে না। বটগাছকেও তারা নিশ্চিন্ত থাকার ব্যাপারে আশ্বাস দিল। তবু বটগাছের ভয় যেন কাটেই না। অঝোরে কাঁদতে থাকে সে।

পরদিন সময় করে সবকিছু নিয়ে কাঠুরে বনের গভীরে সেই বাঁশঝাড়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। উঁকি দিয়ে বটগাছটাকে একবার পরখ করে নেয়। তারপর যখনই তিনি বটগাছটাকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন হঠাৎ লক্ষ করলেন। এই বাঁশঝাড় পেরিয়ে বটগাছ থেকে কাঠ সংগ্রহ করা একেবারেই অসম্ভব। এসব নিয়ে কিছুক্ষণ তিনি ভাবলেন। তারপর সেখান থেকে বিষণ্ণœ মনে চলে গেলেন।

শুরু হলো বটগাছের আনন্দ। বটগাছ পুরো বাঁশঝাড়ের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে ভুলল না। সবাই মিলে নতুন করে বাড়তে লাগল। বসন্তকাল চলে আসায় নতুন করে পাতা গজাল বটগাছটার। এতে সে খুব আনন্দ অনুভব করল। এখন আর কখনো সে নিজের বড়ত্ব নিয়ে কথা বলে না। পাখপাখালি উড়ে এসে তার ডালপালায় বসে হরেক রকমের গান ধরে। সে গান শুনেই কেটে যায় বটগাছের দিনকাল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close