আবদুস সালাম

  ০৪ আগস্ট, ২০১৮

রাজকন্যার বিয়ে

এক দেশে ছিলেন এক রাজা। রাজার ছিল একটি মাত্র মেয়ে। সেই রাজকন্যা ছিলেন রূপবতী। রূপের জন্য দেশ-বিদেশে রাজকন্যার একটা পরিচিতি ছিল। দশ দেশের লোকজন তাকে চিনত। রাজকন্যা সাধারণ কোনো মেয়ের মতো ছিলেন না। তিনি অনেকের থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন। রাজকন্যার বিয়ের বয়স হয়েছে। রাজা চান তাকে বিয়ে দিতে কিন্তু রাজকন্যা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হন না। মেয়েকে নিয়ে রাজার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। রাজা চেষ্টা করছেন তাকে বিয়েতে রাজি করাতে। একদিন রানি রাজকন্যাকে বললেন : মা, তুমি বড় হয়েছো। আমরা চাই তোমাকে বিয়ে দিতে। তুমি রাজি হলে আমরা পাত্র দেখতে পারি। রাজকন্যা সব কথা শুনে বললেন : ‘ঠিক আছে। আমি রাজি। তোমরা পাত্র দেখ। তবে আমার একটা শর্ত আছে। বিয়ের আগে আমি পাত্রকে একটা পরীক্ষা নেব। পরীক্ষায় পাস করলে তাকে বিয়ে করব। আর যদি তিনি পরীক্ষায় ফেল করেন, তবে তাকে কঠোর শাস্তি দেব। পরীক্ষাটি হলোÑপাত্রকে তিন দিন তিন রাত জেগে থাকতে হবে। কোনোভাবেই ঘুমাতে পারবেন না।’

এই অদ্ভুত শর্ত দেওয়ার জন্য রাজা-রানি খুব অবাক হলেন। তারা বুঝতে পারলেন বিয়ে না করার জন্য রাজকন্যা একটা ফন্দি এঁটেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন জেনে তারা আপাতত খুশি হলেন। আপাতত দেখা যাক রাজকন্যার জন্য কোনো পাত্র পাওয়া যায় কিনা। রাজা সবাইকে সুযোগ দিতে চান। তাই রাজা সারা দেশে রাজকন্যার বিয়ের বিষয়ে এলান করে দিলেন। যারা নিজেকে যোগ্য মনে করবেন, তারাই রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী হতে পারবেন। রাজকন্যাকে যে বিয়ে করবেন তিনি হবে খুব সৌভাগ্যবান। কারণ রাজকন্যা রাজার একমাত্র সন্তান। পরবর্তী দেশের ভবিষ্যৎ রানি। রাজকন্যার বিয়ে বলে কথা। দেশের সবচেয়ে উচ্চবংশের, ধনী, শিক্ষিত, গুণী ও সুদর্শন যোগ্য ছেলেরা রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী হলেন। একে একে তারা রাজপ্রাসাদে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আসতে থাকলেন। রাজকন্যা যাকে পছন্দ করবেন তাকেই তিনি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন। রাজকন্যা প্রাথমিকভাবে তার পাণিপ্রার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি আপাতত কোনো পাণিপ্রার্থীকেই যোগ্য মনে করলেন না। তাই সবাইকে মনের দুঃখে ফিরে যেতে হলো। এভাবে দুদিন যাওয়ার পর রাজকন্যা একজনকে পছন্দ করলেন। তিনি ধনী বাবা-মায়ের একমাত্র দুলাল। যেমন শিক্ষিত, তেমনি সুদর্শন। অনেকের ধারণা, ওই ছেলেই হবেন রাজকন্যার জন্য সুযোগ্য পাত্র। এখন শুধু পরীক্ষা দেওয়ার পালা। রাজকন্যা তাকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। যদি তিনি পরীক্ষায় পাস করেন তাহলে রাজকন্যা তাকে বিয়ে করার জন্য বিবেচনা করবেন। আর পরীক্ষায় ফেল করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।

রাজকন্যা প্রথমদিন পাত্রকে পরীক্ষা নিলেন। রাজকন্যা যে ঘরে শুয়ে থাকলেন, সেই ঘরের দরজার কাছে পাত্রটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিলেন। তিনি এক মিনিটও চোখ বন্ধ করেননি। প্রথম দিন তিনি পরীক্ষায় পাস করে গেলেন। দ্বিতীয় দিন একইভাবে তাকে পরীক্ষা দিতে হলো। ফলাফল কী হয় তা জানার জন্য অনেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। রাতেরবেলায় রাজকন্যা ঘরের মধ্যে ঘুমিয়ে আছেন। আর দরজার সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী। রাজপ্রাসাদের আশপাশে অনেক পাহারাদার পাহারা দিচ্ছেন। গতরাতে ঘুম না হওয়ার কারণে তিনি দ্বিতীয় দিন কোনোভাবেই তাকাতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে তিনি দরজার পাশে ঘুমিয়ে পড়েন। রাজকন্যা মধ্যরাতে উঠে দেখেন পাত্র দরজার পাশে ঘুমাচ্ছেন। রাজকন্যা একজন সৈন্যকে হুকুম দিলেন তাকে বন্দি করতে। তারপর তাকে কঠোর সাজা দিয়ে জেলখানায় পাঠিয়ে দিলেন।

এ খবরটি সারা রাজ্যে ছড়িয়ে গেল। এ খবর জানার পরও আবার একটি পাত্র এলো পরীক্ষা দিতে। রাজকন্যা তাকে প্রাথমিকভাবে পছন্দ করলেন এবং পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। রাজকন্যা তাকেও একইভাবে পরীক্ষা নিলেন। তিনিও পরীক্ষায় ফেল করলেন। তাকেও অনুরূপভাবে সাজা দেওয়া হলো এবং জেলখানায় আটকে রাখা হলো। এ ঘটনাও সারা দেশে জানাজানি হয়ে গেল। রাজকন্যাকে বিয়ে করার জন্য পরীক্ষা দিতে কেউ সাহস পেলেন না। তারা বুঝতে পারলেন পরীক্ষাটি আপাতত সহজ মনে হলেও, আসলে তা সহজ নয়। এদিকে রাজা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়ের পাগলামি তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু তিনি কী করবেন তার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পেলেন না। এভাবে আরো কিছুদিন চলে গেল।

দেশে একটা ছেলে বাস করত। তার নাম বাবু। তার বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। সে বিভিন্ন পশুপাখির ডাক নকল করতে পারত। শুধু তা-ই নয়, মাঝেমধ্যে ভয়ংকর কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারত। ডাকগুলো সত্যি মনে করে অনেকেই ভয় পেয়ে যেত। পশুপাখির ডাক নকল করতে পারত বলে তার এলাকায় অনেকে তাকে নকল বাবু বলে ডাকত। সে মনে মনে ভাবল, আমি রাজকন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব। রাজকন্যা যত কঠিন পরীক্ষাই নিক না কেন, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি পরীক্ষা দেব। এই পরীক্ষা না দেওয়ার জন্য বাবুর বাবা-মা তাকে বারবার নিষেধ করলেন কিন্তু সে কারোর কথা শুনল না। সুযোগমতো একদিন বাবু রাজদরবারে হাজির হলো এবং রাজকন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। রাজকন্যা তার পারিবারিক পরিচয় জেনে খুব রেগে গেলেন। তবে রাজকন্যা জানতেন না যে সে পশুপাখির ডাক নকল করতে পারে। রাজকন্যা মনে মনে ভাবলেন, পরীক্ষাটি নিয়ে তাকে একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেব। ওকে বোঝাতে হবে রাজকন্যাকে বিয়ে করার সাধ কেমন লাগে। অবশেষে রাজকন্যা তাকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।

বরাবরের মতো রাতেরবেলায় রাজকন্যা তার শয়নকক্ষে শুয়ে আছেন। আর নকল বাবু দরজার পাশে পাহারা দিচ্ছে। রাত যখন একটু গভীর হলো, ঠিক তখন সে অদ্ভুত একটা ভয়ংকর শব্দ করল। শব্দ শুনে রাজকন্যার ঘুম ভেঙে গেল। রাজকন্যা চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। ঘরের বাইরে বের হয়ে নকল বাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন : কিসের শব্দ শোনা গেল?

-শব্দটা ছিল একটা দুষ্টু ভূতের।

-আগে তো কখনো শুনিনি।

-ঠিকই বলেছেন। ভূতটি আগে কখনো এই দেশে আসেনি। নতুন এসেছে।

-সে এখানে কেন? কী চায়?

-ও সুন্দরী অবিবাহিতা মেয়েদের রক্ত চুষে খায়। রক্ত খাওয়া তার নেশা। রক্ত খাওয়ার পর তাকে হত্যা করে। সে অতীতে বহু সুন্দরী নারীকে হত্যা করেছে। তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি এখানে থাকলে সে কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

-তুমি ভয় পেয়ো না?

-এসব ভূত-পেতœীকে আমি মোটেই ভয় পাই না। এদের কাছে পেলেই আমি তাদের কঠোর শাস্তি দিই। আমি আছি বলে সে এখানে আসতে সাহস পাচ্ছে না।

রাজকন্যার মনে ভয় ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আবার যখন রাজকন্যা চোখ বন্ধ করলেন, ঠিক তখন নকল বাবু হিংস্র ক্ষুধার্ত পশুর মতো শব্দ করতে থাকল। রাজকন্যা ওই শব্দ শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ঘরের বাইরে বের হয়ে এলেন এবং নকল বাবুকে ওই শব্দের বিষয়ে জানতে চাইলেন। নকল বাবু বলল : ‘ওই দুষ্টু ভূতের সঙ্গে কয়েকটি রাক্ষসও আছে। তারা বেশ কিছুদিন কোনো সুন্দরী অবিবাহিত নারীর রক্ত খায়নি। তাই সে সুযোগ খুঁজছে এখানে আসার জন্য। ও নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি থাকলে ওদের সাহস হবে এখানে আসার। তবে সাবধান! ওদের বিষয়ে কারোর সঙ্গে কোনো আলাপ করবে না। করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তারা মানুষের রূপ ধরে ঘরের মধ্যে চলে আসবে। এতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে!’

সেই রাতে আর রাজকন্যার কোনো ঘুম হলো না। দুশ্চিন্তা করতে করতে সকাল হয়ে গেল। তার চোখে-মুখে বিষণœতার ছাপ। রাজা-রানি এর কারণ জানতে চাইলেন কিন্তু কোনো উত্তর পেলেন না। সারা দিন রাজকন্যার মনটা খুব খারাপ থাকল। ক্ষণে ক্ষণে গত রাতের কথা তার মনে হলো। আর ভয়ে তার জানটা শুকিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ভাবতে থাকলেন কীভাবে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। নানান কিছু ভাবতে ভাবতে আবার রাত হয়ে গেল। রাজকন্যা ভয়ে ভয়ে আবার তার শয়নকক্ষে ঘুমাতে গেলেন। আর নকল বাবু গত রাতের মতো দরজার পাশে পাহারা দিতে থাকল। গভীর রাতে আবার নকল বাবু সেই আগের মতো শব্দ করতে থাকল। এবার শব্দটা ভিন্ন ধরনের। শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজকন্যার ঘুম ভেঙে গেল। রাজকন্যা খুব ভয় পেলেন। রাজকন্যা নকল বাবুর কাছে শব্দটির বিষয়ে জানতে চাইলেন। বাবু বলল : ‘সেই ভূতটি প্রাসাদের আশপাশেই রয়েছে। তবে সে তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ রাজকন্যা বাবুকে অনুরোধ করে বললেন : ‘তুমি আমার ঘরের ভেতরে আসো। আমি খুব ভয় পাচ্ছি।’ কিন্তু নকল বাবু তার কথায় রাজি হলো না। সে বলল : ‘আমি বিয়ে করা ছাড়া কোনো অবিবাহিত মেয়ের ঘরে থাকতে পারব না।’ তার কথা শুনে রাজকন্যা বললেন : ‘আমি আগামীকাল সকালেই বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলব। তুমি আপাতত আমার ঘরের মেঝেতে শুয়ে থাকো।’ অবশেষে নকল বাবু রাজকন্যার ঘরের মেঝেতে শুয়ে থাকল। আর রাজকন্যা শুয়ে থাকলেন খাটের ওপর।

পরের দিন সকালবেলায় রাজকন্যা রাজাকে বললেন : ‘নকল বাবুকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি তাকে বিয়ে করব। আপনি আজই বিয়ের আয়োজন করুন।’ রাজা একজন কৃষকের ছেলের সঙ্গে রাজকন্যাকে বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। রাজকন্যা রাজাকে বললেন : ‘আপনি যদি আমাকে জীবিত দেখতে চান, তাহলে আজই বিয়ের আয়োজন করুন।’ রাজা এর কারণ জানতে চাইলে রাজকন্যা বলেন : ‘এসব বিষয়ে আলোচনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাতে আমার ক্ষতি হবে। আমি মারাও যেতে পারি।’ কোনো উপায় না পেয়ে রাজা বিয়ের আয়োজন করলেন এবং বেলা থাকতে থাকতেই নকল বাবুর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। একজন সাধারণ কৃষকের ছেলে হলেন রাজকন্যার স্বামী। রাজকন্যা কেন তাকে পছন্দ করলেন দেশের কেউই বুঝতে পারল না।

যাই হোক, রাজকন্যার আর কোনো চিন্তা নেই। কারণ তিনি এখন বিবাহিতা। তার সঙ্গে থাকবেন নকল বাবু অর্থাৎ তার স্বামী। শুধু বাসর রাতেই নয়, নকল বাবু কোনোদিনই আর কোনো ভয়ংকর শব্দ করেননি। এতে রাজকন্যারও বিশ্বাস হলো, স্বামী পাশে থাকলে কোনো ভূত-পেতœী কিংবা রাক্ষস-খোক্ষস তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। নকল বাবুকে স্বামী হিসেবে পেয়ে রাজকন্যা খুব খুশি হয়েছে। আর মেয়ের খুশিতে রাজা-রানিও খুশি। বিয়ের পর স্বামীকে ছাড়া রাজকন্যা একদিনও একাকী থাকেননি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist