হাসান শান্তনু
বিতর্কে ষোড়শ সংশোধনী
আইনি পথে রায় মোকাবিলা আ’লীগের
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। এ রায় আইনগতভাবে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। রায় নিয়ে জাতীয় সংসদের বাইরে ও মাঠে থাকা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে রায়ের বিষয়ে সরকারের অবস্থানও তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি রায়ের যেসব অংশের সঙ্গে সরকার ও আওয়ামী লীগের দ্বিমত, সেসব বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশ অনুযায়ী, নেতারা রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মাঠে-ময়দানে বক্তব্য দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ প্রধান ও সরকার প্রধান শেখ হাসিনাও রায়ের বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। বিভিন্ন সভা ও সমাবেশের মাধ্যমে এ বিষয়ে দলটির নেতারা জনগণকে সচেতন করার জন্য দলীয় শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলটি মনে করে, প্রধান বিচারপতির কিছু পর্যবেক্ষণ আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক। এমনকি অধস্তন আদালতের শৃঙ্খলাবিষয়ক ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রধান বিচারপতির রায় যুক্তিতাড়িত নয়, বরং আবেগ ও বিদ্বেষতাড়িত। রায়ে ব্যাপকভাবে অসাংবিধানিক ও অনৈতিক কথাবার্তা আছে বলেও মনে করেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর মূলত বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে সরকারের নীতিনির্ধারকরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের নির্দেশনা দেন, বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায়। তখন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের পক্ষে মত দেন অনেকেই। বিষয়টি নিয়ে এখন সরকারি দলের উচ্চ পর্যায়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনা চূড়ান্ত হওয়ার পর জাতীয় সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের বিল আনা হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন। রায় আইনগতভাবেই মোকাবিলা করা হবে বলে এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। রায়কে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার কোনো অভিপ্রায় দলটির নেই। কিন্তু এখানে যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য আনা হয়েছে, তা নিয়ে গঠনমূলক আলাপ-আলোচনার জন্য যদি রাজনীতিবিদরা কোনো বক্তব্য দেন, তাহলে সেটা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার শামিল বলে মনে করেন দলের আইন বিশেষজ্ঞরা।
গত বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লী ও সম্পাদকম-লীর যৌথ সভায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতির এক পর্যবেক্ষণের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘হ্যাঁ, একক চেষ্টায় কোনোকিছুই হয় না। কিন্তু সবকিছুর পেছনে কারো উদ্যোগ থাকে, প্রেরণা থাকে, সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকে এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার শক্তি থাকে। সেই শক্তি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।... অবশ্যই সম্মিলিত প্রচেষ্টায়... একজন না একজন নেতৃত্বে থাকে।’ কারো নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘তারপরও কিছু কিছু লোক থাকে, যারা এই বিকৃত ইতিহাসকে সামনে আনার চেষ্টা করে।’ রায়ের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ‘কোনো একক ব্যক্তির কারণে হয়নি’ বলায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনা করে আসছেন মন্ত্রীরা। শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য এটাই, যারাই বাঙালি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে, যারাই এই জাতির মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কাজ করে এবং মানুষ একটু সুফল পেতে চেষ্টা করে, তখনই যেন একটি ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠতে চেষ্টা করে।’
দলটির মতে, আদালতের এ ধরনের পর্যবেক্ষণ অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত ও অপ্রাসঙ্গিক। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের রিভিউর কথা আওয়ামী লীগ ভাবছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ম-লীর সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। গত বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়। দলের পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় ও পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরতে এর মধ্যে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে গত ১০ আগস্ট অবস্থান তুলে ধরেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের ‘৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্য তথ্যনির্ভর নয়।’ আর তড়িঘড়ি করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা দুঃখজনক। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণে এই কাউন্সিল অস্বচ্ছ এবং নাজুক। সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে আনিসুল হক আরো বলেন, পর্যবেক্ষণের ‘আপত্তিকর’ ও ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বক্তব্যগুলো বাদ দেওয়ার (এক্সপাঞ্জ) উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে এই রায় রিভিউ করার বিষয়েও চিন্তাভাবনা হচ্ছে এবং রায় আইনগতভাবেই মোকাবিলা করা হবে। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়বস্তু ও রায়ের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন আইনমন্ত্রী। তবে রায়ের চেয়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে বেশি অসন্তোষ ফুটে ওঠে তার বক্তব্যে।
রায়ের রিভিউ করার বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যেহেতু রায়ে সংক্ষুব্ধ, তাই নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা করছি যে এই রায়ের রিভিউ করা হবে কি না। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি। কারণ, রায়ের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখনো নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।’
তবে রায় প্রকাশের ১০ দিনের মাথায় সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এলো। অবশ্য এর আগে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এই রায়, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এরপর গত বুধবার ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। একই দিনে সংবাদ সম্মেলন করে এই রায় সম্পর্কে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বরং এটা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে প্র্রধান বিচারপতি যে রায় দিয়েছেন, তাতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কটাক্ষ করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। তিনি এর ধিক্কার জানান। এ রায়ে বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত বিষয় আছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, প্রধান বিচারপতি যে রায় দিয়েছেন, তাতে ব্যাপকভাবে অসাংবিধানিক ও অনৈতিক কথাবার্তা বলেছেন। যেসব অনাকাক্সিক্ষত বিষয় রায়ে উল্লেখ আছে, তা পুনর্বিবেচনা করেন। জনগণের মনে দুঃখ দিয়ে কোনো বিচারকার্য সম্ভব নয়। যদি কোনো দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থার সংকট দেখা দেয়, সে দেশ কিন্তু প্রলয়ংকরী বিপদের মধ্যে পড়ে।’ শুক্রবার দুপুরে মাদারীপুরের শিবচরে শেখ হাসিনা সড়ক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায় নিয়ে এর মধ্যে সংসদেও উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। রায়ের প্রসঙ্গ তুলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ সরকার দলের সিনিয়র সংসদ সদস্যরা আদালতের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সিনিয়র মন্ত্রীরাও আলোচনায় অংশ নেন। তারা বলেন, সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এ রায় অনভিপ্রেত। মামলার শুনানিতে এমিকাস কিউরিদের বক্তব্য নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন সংসদ সদস্য তাদের সুবিধাভোগী আখ্যা দিয়েছেন।
তথ্যমতে, গত ১ আগস্ট আপিল বিভাগ এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। রায় অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরছে। রায় প্রকাশের পর ৬ আগস্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়।
"