জাহিদুল ইসলাম

  ২১ মে, ২০২৪

ভুল সিদ্ধান্তের চাপে অর্থনীতি

করোনা মহামারির পর যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল বিশ্ব অর্থনীতি, ঠিক সেই সময় রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়ে নতুন করে শুরু হয় বিশ্বমন্দা। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া ও পণ্য পরিবহনে সংকটের পাশাপাশি দেশে দেশে তৈরি হয় ডলার সংকট। বেড়ে যায় ডলারের চাহিদা ও মূল্য। এই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় অনেক দেশ। আর্থিকভাবে দেউলিয়াত্বের পথে থাকা শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে চাপে থাকা অর্থনীতিতে গতি আনতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে আফগানিস্তানেও ফেরে অর্থনৈতিক সুবাতাস। ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী হতে থাকে দেশটির মুদ্রা আফগানি। তবে বিপরীত চিত্র এখন বাংলাদেশে। ডলার সংকটে ক্রমাগত বাড়ছে রিজার্ভের পতন, বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অর্থপাচারের ঘটনা। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকও বেশকিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেসব সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী বলছেন না অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের অভিমত দেশের এই অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সিদ্ধান্তের ভুল।

টাকার অব্যাহত পতন ঠেকাতে ব্যর্থতা : ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে ২০২২ সালের ২৯ মে ডলার রেট ৮৯ টাকা ৫০ পয়সা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ডলারের বিনিময় হারও নির্ধারণ করা হয়। রেমিট্যান্স আয়ের বিপরীতে সর্বোচ্চ ১১৫ টাকা হার নির্ধারণ করে ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর। কিন্তু এরপরও ঠেকানো যায়নি টাকার অবমূল্যায়ন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয় ২৬ শতাংশেরও বেশি, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপরও দেশের ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকট কাটেনি। এখন নির্ধারিত দামে কোনো ব্যাংকই ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারেনি। অন্যদিকে কার্ব (খুচরা) মার্কেটে গত ৯ নভেম্বর প্রতি ডলারের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ১২৭ টাকায়। এমনকি রেমিট্যান্সের ডলারের বিপরীতে ১২৪ টাকা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে থাকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সম্প্রতি ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এটিকেও উপযুক্ত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছেন না অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে ক্রলিং পেগের অনেক ঝুঁকি রয়েছে, যেমন- কৃত্রিম বিনিময় হার তৈরি হয়; ফটকাবাজ, ফরেক্স ব্যবসায়ী এবং বাজারে ঝুঁকি তৈরি করে, যা মুদ্রা বিনিময়কে অস্থিতিশীল করে তোলে; যা এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্রলিং পেগের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ ও কারসাজির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেতে পারে। কিছু দেশে ক্রলিং পেগের উপযুক্ততা প্রমাণ হলেও বেশির ভাগ দেশে এই পদ্ধতি সফল হয়নি। ফলে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই এই পদ্ধতি বাতিল করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে কিছুটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে। এজন্য ব্যাংক খাতসহ আর্থিক খাতের কার্যকর সংস্কার করে দ্রুত দেশ ব্যাংক ও মুদ্রানীতিতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় যাতে বাড়ে, সেই ব্যবস্থাও নিতে হবে।

আশানুরূপ নয় রেমিট্যান্সপ্রবাহ : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে গত এপ্রিলে রেমিট্যান্স এসেছে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সের এই প্রবাহকে আশানুরূপ বলছেন না অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। এজন্য ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোকেই দায়ী করছেন তারা। তাদের মতে, হুন্ডি কারবারিদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে কোনো নীতিই কাজে আসবে না। প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স আনতে সরকারের ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত দিচ্ছে আরো ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা। বৈধ পথে দেশে বৈদেশিক আয় পাঠালে মোট ৫ শতাংশ প্রণোদনা পাবেন তারা।

কিন্তু লক্ষণীয় যে, প্রণোদনা সত্ত্বেও প্রবাসীরা বৈধ পথে তথা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আকৃষ্ট হচ্ছেন না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশানুরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। হুন্ডিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

রিজার্ভণ্ডপতন ঠেকাতে ব্যর্থতা : ২০২২ সালের ১২ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২তম গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান আবদুর রউফ তালুকদার। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রোস রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৯৫৯ কোটি ৯৯ লাখ ডলার বা ৩৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। এ রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। এখন ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলার বলে জানা গেছে। মাত্র তিন মাসের আমদানি-রপ্তানি ব্যয় মিটানোর সক্ষমতার আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। রিজার্ভের এই অবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও এলসি নীতিকে দুষছেন ব্যবসায়ীরা। আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গিয়ে এলসি খুলতে ব্যর্থ হচ্ছে তারা। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সংকটে বাড়ছে পণ্যমূল্য। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানি করতে না পারায় রপ্তানি পণ্য তৈরি করা যাচ্ছে না। সমাজে বাড়ছে না কর্মসংস্থান।

কাছে আসছে না নতুন সুদহার : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, চলতি বছরের মার্চে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তবে শহরে এই মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সুদের হার জোর করে ৯ শতাংশে ধরে রাখার ফলেই এমন অবস্থা বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। অবশ্য আইএমএফের চাপে বর্তমানে সুদ হার বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ব্যাংকে আমানত কমেছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটারি পলিসি ডিপার্টমেন্টের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটর থেকে দেখা যায়, ২০২২ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে যেখানে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে মানুষের হাতে নগদ ২ হাজার ২৫৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ছিল। সেখানে ২০২৩ অর্থবছরে এই নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৫৪৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আইএমএফের তথ্য মতে, ২০২১ সালে ১৫ বছর বা তার অধিক জনগোষ্ঠীর ব্যাংকিং প্রবণতা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে এই শ্রেণির জনগোষ্ঠীর ব্যাংকিং প্রবণতার হার মাত্র ৩১ শতাংশ। অথচ উন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপানে এই হার প্রায় ৯৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৯৬ ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯৪। এ ছাড়া প্রতিবেশী ভারতে ৪১ ও পাকিস্তানে ৩৬ শতাংশ। বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বড় অদক্ষতা হয়ে দেখা দিয়েছে বড় অঙ্কের কুণ্ডঋণ ও খেলাপি-সংস্কৃতি।

খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি হয়েছে শিল্প খাতে ৩৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং এরপরই শীর্ষ খেলাপি হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য খাত ৩৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সুশাসনের অভাবকেই দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। যেমন অদক্ষ ব্যবস্থাপনা বা নৈতিক বিপর্যয়। এসব ক্ষেত্রে ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক পক্ষ এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

সুশাসনের অভাব : দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে যে কয়েকটি কারণ রয়েছে তার মধ্যে সুশাসন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকট অন্যতম। এসব কারণে ব্যাংকগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। খেলাপিরা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে এর একটি বড় অংশ যে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে, তা ওপেন সিক্রেট। ফলে অর্থনীতিতে বাস্তবে অর্থ থাকছে না, জিডিপিতে দেখানো হলেও বাস্তবে এই অর্থ দেশে নেই।

ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর সুশাসন ও দক্ষতার অভাব এবং উচ্চ খেলাপি ঋণ রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে না। এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে অধিগ্রহণকারী ব্যাংককে। এতে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের মুনাফার হার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে দুর্বল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির মাধ্যমে কিনে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদদের মত হচ্ছে, করদাতারা এমন একটি উদ্যোগের অনুমোদন দেবে বলে মনে হয় না। কারণ এর মাধ্যমে বেশির ভাগ রাজনৈতিকভাবে সমর্থিত বড় ঋণখেলাপিরা অন্যায় সুবিধা পাবেন। তাই ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের নাম প্রকাশ করতে হবে। তা না করে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ করলে ঋণখেলাপিদের শাস্তি হবে না। দেশের ব্যাংকিং খাতে ও সুশাসন আসবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close