মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪

মতামত

গুণসম্পন্ন মানুষই গড়ে আলোকিত সমাজ

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। জন্মগ্রহণের সময় মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেন একবারে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ রূপে। জন্মের পর থেকে শিশু বিস্ময়ে চোখ মেলে পৃথিবীর আলো দেখে, তার মা-বাবা, তাকে ঘিরে থাকা মানুষজন, সামগ্রিক পরিবেশ থেকে সব বুঝতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এসব থেকেই তার প্রথম শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। পরবর্তীকালে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বৃহত্তর পরিসরে জ্ঞানার্জনের সুযোগ লাভ করে। তবে পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তবে শিক্ষা তা যেখানে যেভাবেই গ্রহণ করা হোক না কেন তা অবশ্যই হতে হয় সুশিক্ষা। এর ব্যতিক্রম হলে যা হয় তার উদাহরণ তো আমাদের চারপাশেই রয়েছে। যাদের দ্বারা বড় ধরনের অন্যায়, অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই কিন্তু অশিক্ষিত নন। অন্তত পুঁথিগত বিদ্যায় তারা বেশ এগিয়ে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষই আজ অবলীলাক্রমে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে রয়েছেন। খাদ্যপণ্যে ভেজালের ছড়াছড়ি চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য মজুদ করে অস্বাভাবিক কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জিনিসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ওষুধে ভেজাল মিশিয়ে মানুষ হত্যা করতে পিছ-পা হচ্ছে না। আয়কর ফাঁকি দিয়ে দেশ ও জাতিকে ঠকাচ্ছেন এক শ্রেণির মানুষ। মানুষই সামান্য স্বার্থের কারণে মানুষ হত্যা করছে। নারী যাকে সম্মানের আসনে বসানোর কথা, তারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছেন। শিশু-কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর সব অপরাধে। রাহাজানি, খুনখারাবি তো রয়েছে দেশজুড়ে। অবুঝ শিশু ধর্ষিত হচ্ছে তারই নিকটাত্মীয় দ্বারা। সামান্য স্বার্থের জন্য অবাধে নারীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। বাবা-মায়ের দ্বারাও সন্তান হত্যার নজির আজ আর বিরল নয়। শিক্ষাগ্রহণের যথার্থতা প্রমাণিত হয় চরিত্র পরিবর্তনের সুস্পষ্ট লক্ষণের মাধ্যমে। সচ্চরিত্র গঠনই শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য। ঘরে বাবা-মা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক বা পারিপার্শ্বিকতা থেকে শৈশব-কৈশোরে যে মানবিক মূল্যবোধের সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর বীজ বপন করা হয়, তা সঞ্চারিত হতে থাকে জীবনের প্রতিটি স্তরে। মানবিক মূল্যবোধ অর্জিত গুণাবলি একজন মানুষের জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। আর তা মানুষকে সব পাপাচার থেকে দূরে রেখে সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনে সাহায্য করে। বাংলাদেশে শিক্ষার হার নিঃসন্দেহে বাড়ছে। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। এ শিক্ষা তাদের মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে কতটা ভূমিকা রাখছে, সেটাই ভাবার বিষয়। আজ বিশাল উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অনেকেই নিয়োজিত হচ্ছেন দেশ-বিদেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে। কেউ কেউ বহাল হচ্ছেন রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে। কিন্তু দেশের অগ্রগতির বিশাল কর্মযজ্ঞে শিক্ষিত মানুষের বিকশিত মানবিক সমাজ বিবর্তনে কতটা ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে, সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

আমাদের দেশে শিশুশিক্ষার পাঠ্যক্রমে মূল্যবোধ বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তেমন স্থান পেতে যায় না। সুবচনগুলো নির্বাসনে গেছে দীর্ঘকাল আগে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা পাঠ্যক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীকে তেমন কিছু শেখাবার তাগিদ অনুভব করেন বলে মনে হয় না। শিক্ষকদের মধ্যেও তো রয়েছে বিভাজন, দলাদলি। আর শিক্ষার্থীরা এসবের সুযোগ নেবে তা অস্বাভাবিক নয়। শিক্ষকদের দলাদলির কারণে তাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধের স্থানটি অনেকটা বিচ্যুত হয়েছে সন্দেহ নেই। আজকাল ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার নামে পাঠ্যপুস্তকে যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তার অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের হৃদয়ঙ্গম করে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে বলে দৃশ্যমান নয়। আর সন্তানের মা-বাবারাও তাদের জীবনের স্থূল চাহিদায় এত ব্যস্ত থাকেন যে সন্তানের চরিত্র গঠনের দিকে খেয়াল রাখার তেমন সুযোগ পান না। শিশুসন্তানদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গৃহকর্মীর ওপর সন্তানের দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান তারা। কখনো পাঠিয়ে দেন শিশুপালন কেন্দ্রে। শিশুমন হচ্ছে কাদামাটির মতো। তাকে যেভাবে ইচ্ছে গড়ে তোলা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু নিবিড় পরিচর্যা। এসবের প্রতি যত্নশীল না হয়ে কর্মব্যস্ত জীবনের জাঁতাকলে পিষ্ট মা-বাবা সন্তানের মানসিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছেন। জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের প্রত্যাশায় শিশুর সামনে তুলে দেন কতগুলো ভারী ভারী বই। সারা দিন তাকে ব্যস্ত রাখেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানে। কখনো গৃহশিক্ষক দিয়ে পড়িয়ে বা কোচিং সেন্টারে পাঠিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করতে চান। যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে অনেক দিন আগে। আজকের শিশুসন্তানরা দাদা-দাদি, কাকাণ্ডকাকির স্নেহ-আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেশির ভাগ পরিবারে থাকে একটি বা দুটি সন্তান। কাজেই পরিবারে বুড়োদের সাহচর্য, তাদের কাছ থেকে শিশুকালে নৈতিক শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থাকে না। নিঃসঙ্গ শিশু-কিশোররা একাকিত্বে ভোগে, শিকার হয় এক প্রকার মানসিক বৈকল্যের। শুধু ভালো একটি স্কুলে ভর্তির টার্গেট নিয়ে একজন শিশুর জীবনের যে শুরুটা হয় হয়তো তার পরিসমাপ্তি ঘটে, শুধু নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণীল একটি সনদপত্রপ্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু তার শেষ পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা পূর্বাহ্নেই ভেবে দেখা দরকার। এ যুগে কেউ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরমান ধারার বিপক্ষে নয়। তবে আজকাল প্রয়োজন ছাড়াই অনেক মা-বাবা, অভিভাবক সামান্য স্কুলপড়ুয়া ছোট্ট ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেন নামিদামি ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনসেট। এ নিয়েই দিনরাত ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলেমেয়েরা। মোবাইল ফোনের অপব্যবহারে শিশু-কিশোর অপরাধও বাড়িয়ে তুলছে। মা-বাবা অজান্তেই সন্তানকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছেন। একজন শিশু-কিশোরকে যদি তার মা-বাবাই বিপদগামী হতে বাধা দিতে না পারেন, তাহলে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা অন্য কারো পক্ষে এ কাজটি করা সহজ নয়, এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেও।

আজকাল জীবনের উদ্দেশ্য বলতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, ব্যবসায়ী বা বড় আমলা হওয়ার ইচ্ছা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। একজন ভালো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার আসল লক্ষ্য হয়ে যায় গৌণ। জীবনে বিত্তশীল হয়ে ওঠার নেশায় নষ্ট করে দেওয়া হয় শৈশব-কৈশোরের সব আনন্দ আয়োজন। বন্ধ ঘরে একগাদা বই আর কম্পিউটারের চাপে তাকে নিয়ত হতে হয় পিষ্ট। আজকাল শিশু-কিশোরের জন্য বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই লেখাধুলার মাঠ। সুন্দর একটি পার্ক নেই, যেখানে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়! মাঠে, খোলা সবুজে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস টেনে, কিছু সময় দিয়ে প্রকৃতি থেকে কিছু শিখে বড় হওয়ার কোনো সুযোগই আজকাল শিশুদের নেই। আগের দিনে পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার ছিল। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সেসব গড়ে তোলা হতো। ছেলেমেয়েদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও সেখানে ভালো বই পড়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগ মিলত। খেলাঘর, উদীচী, কচিকাঁচার আসরের মতো শিশু-কিশোর সংগঠনের কর্মকাণ্ড ছিল জমজমাট। সেখানে সুস্থধারার সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে চরিত্র ও মানবিক উৎকর্স সম্ভব হতো। দেশের দুর্যোগকালে এসব সংগঠনের ছেলেমেয়েরা অনায়াসে উদার হাত বাড়িয়ে দিত। এসব আজকাল অনেকটা সংকুচিত হয়ে গেছে। শুধু পাঠপুস্তক পড়ে সীমিত গণ্ডির মাঝে বিচরণ করে সুকুমার বৃত্তিচর্চা, মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। মানুষের প্রতি সহমর্মী হওয়াও বড় কঠিন।

সুস্থধারার শিল্প-সংস্কৃতির সংযোগ ছাড়া শিক্ষার ফলে বিরাজমান পরিবেশ, পরিস্থিতির মধ্য থেকে সমাজের প্রতি পদে প্রত্যক্ষ করতে হয় চরম ভণ্ডামি আর নীতিহীনতা। জীবনে বিপুল অর্থ-সম্পদ গড়ার পেছনে ছুটে চলার দুর্নিবার নেশায় চেপে ধরা জীবনে সমাজের জন্য মহৎ কিছু করার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। বিত্তবৈভব আর প্রাচুর্যে জীবনকে রাঙিয়ে তোলার প্রবল বাসনা মানুষের ভেতরকার জীবনবোধকে ক্রমেই কুরে কুরে খেতে থাকে। একসময় সে নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলে জীবনের মূল চালিকাশক্তি- সততা ও নিষ্ঠার মতো মানবিক গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে জীবনকে পরিচালিত করার সব শক্তি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেরই অর্থনৈতিক কাঠামো এত সহজে, রাতারাতি বিত্তশীল হওয়ার তেমন অনুকূলে নয়। কাজেই দ্রুত গতিতে অর্থবিত্ত কামাতে হলে অনেকেরই আশ্রয় নিতে হয় অনিয়ম আর দুর্নীতির। আর একবার ওই পথে পা বাড়ালে সেখান থেকে ফিরে আসা বড্ড কঠিন হয়ে যায়। লোভণ্ডলালসা মানুষকে বড় বেপরোয়া করে তোলে। একজন উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী বা যেকোনো পেশায় থেকে গাড়ি-ঘোড়ায় তার ঠিকই চড়া হয়, কিন্তু জীবনের সত্যিকারের সুখ-সাচ্ছন্দ্যের সন্ধান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। মুষ্ঠিমেয় জনগোষ্ঠীর হাতে অগাধ অবৈধ সম্পদ চলে গেলে বাড়ে আয়বৈষম্য। বৃদ্ধি পায় দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের হার। মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের মনে সঠিক দায়িত্ব পালন এবং কর্তব্যবোধের সৃষ্টি হয়। সুশিক্ষা বিকাশ ঘটায় মানবিক মূল্যবোধের। আর মানবিক মূল্যবোধ ছাড়া মানুষ কখনো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। সৎকর্ম ছাড়া কোনো ধর্মবিশ্বাসেরও সফল বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। প্রতিটি ধর্মের মূলমন্ত্রকে কর্মে প্রতিষ্ঠা করে সঠিক সরল পথে নির্লোভ সৎ জীবনযাপন করাই সুস্থ জীবনের লক্ষ্য। শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় এবং সমাজ কাঠামোর প্রতিটি স্তরে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নিতে হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। মানুষই হচ্ছে একটি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুশীলসমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার চালিকাশক্তি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close