রাবি প্রতিনিধি

  ০১ মে, ২০২৪

রাবিতে হলে সিট দখলের নতুন কৌশল

গত বছর ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে সভাপতি এবং আসাদুল্লা-হিল-গালিবকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এ দুই নেতা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই হলগুলোয় বর্তমান সিট বাণিজ্য ও অবৈধভাবে রুম দখলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এই কমিটি ঘোষণার কয়েক মাস না যেতেই নানা অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছেন বর্তমান কমিটির নেতাকর্মীরা। হল থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়ার ঘটনা এখন প্রায়ই ঘটে। তারা সিট দখলের নতুন কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে ‘জয়বাংলা ব্লাড স্কিম’। এর আড়ালে নিয়মিত চলছে ছাত্রলীগের ‘রুম ওয়ার্ক’। ছাত্রলীগ এটাকে রুম দখলের নতুন কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে বলে অভিযোগ করছেন আবাসিক শিক্ষার্থীরা। তবে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হলা হয়েছে, কারো সিট দখল করা আমাদের জয়বাংলা ব্লাড স্কিম প্রকল্পের উদ্দেশ্য নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে হলগুলোয় নতুন করে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছে বর্তমান কমিটি। হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা রক্তের গ্রুপ সংগ্রহের নাম করে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের রুমে রুমে যাচ্ছেন। ছাত্রলীগ যার নাম দিয়েছে জয়বাংলা ব্লাড স্কিম কার্যক্রম। প্রথমে সালাম দিয়ে শিক্ষার্থীদের রুমে প্রবেশ করেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রুমে প্রবেশ করেই জয়বাংলা ব্লাড স্কিম থেকে রক্তের গ্রুপ ও খোঁজ নিতে এসেছি, আমরা ছাত্রলীগ, এমন পরিচয় দিয়ে থাকেন তারা। প্রথমে জানতে চাওয়া হয় কক্ষে অবস্থানরত শিক্ষার্থীর রক্তের গ্রুপ। পরে নাম, সেশন, বিভাগ ও তাদের নম্বর নিয়ে চলে যান তারা। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর পুরো তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। পরবর্তী সময়ে হলে অবস্থানরত কোনো শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক সেশন শেষ হয়ে গেলে তার নম্বরে যোগাযোগ করে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে। কোনো শিক্ষার্থী হল ছাড়তে না চাইলে তাকে নানাভাবে হুমকিও দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিছু দিন আগেই শিক্ষার্থীদের রুমে রুমে গিয়ে ব্লাড গ্রুপসহ শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করেছেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এদিকে বিসিএস পরীক্ষা শেষ না হতেই আবারও ব্লাড গ্রুপ জানতে শিক্ষার্থীদের কক্ষে প্রবেশ করছেন ছাত্রলীগের এসব নেতাকর্মী।

রুম ওয়ার্কের জন্য মধ্যরাতেও শিক্ষার্থীদের দরজায় কড়া নাড়েন তারা। এ নিয়ে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়াতেও দেখা যায়। তথ্য সংগ্রহ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগ উঠেছে হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে। এতে অতিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি আবাসিক হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কাউকে সিট থেকে নামিয়ে দেওয়া ও উঠানোর পুরো বিষয়ে তদারকি করছেন ছাত্রলীগ। তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে হল প্রশাসনও।

এ বিষয়ে ইমরান নামের এক ভুক্তভোগী আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, ব্লাডগ্রুপ সংগ্রহের আড়ালে ছাত্রলীগের রুম ওয়ার্কের ফলে প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকতে হয়। পড়াশোনা শেষ না হলেও, হল সমাপনী হয়ে যাওয়ায় হল ছাড়ার নির্দেশ দেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রথম দিন আমার তথ্য নিয়েছে। এরপর থেকে টানা তিন দিন আমার রুমে লোক পাঠিয়েছে কবে রুম ছাড়ব। এ নিয়ে আমি মানসিকভাবে টেনশনে আছি।

ছাত্রলীগের জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে রুম দখলের অভিনব কৌশল নিয়ে ব্যঙ্গভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতে দেখা যায় আদনান মাহিম নামের এক শিক্ষার্থীকে। তিনি তার পোস্টে লিখেছেন, ‘সরকার খুলেছে সার্বজনীন পেনশন স্কিম আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র সংগঠন খুলেছে জয়বাংলা ব্লাড স্কিম। গত এক মাস আগেই তারা হলের রুমে এসে সবার তথ্য এবং ব্লাড গ্রুপ লিখে নিয়ে যায় এবং যথারীতি তার পরের দিন আসে মাস্টার্সের কেউ থাকলে তার কতদূর জানার জন্য। আজ আবার সেই পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি, বিসিএস পরীক্ষা শেষ মানে আবার রক্তের গ্রুপ দরকার। তাই তারা আবার হাজির সবার ব্লাড গ্রুপ জানার জন্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, কিছু দিন আগে মধ্যরাতে আমার রুমে কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী এসে না বলেই ঢুকে পড়েন। এসেই জয়বাংলা ব্লাড স্কিম থেকে এসেছি বলেই আমার সব তথ্য নিয়ে গেলেন। একজন শিক্ষার্থীর রুমে অনুমতি ছাড়া কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী প্রবেশের অনুমতি আছে কি না, হল প্রশাসনের কাছে এমন প্রশ্ন তার।

জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে শিক্ষার্থীদের বিভাগ ও সেশনের তালিকা করে সেই অনুযায়ী তাদের হল থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, ‘যদি এরকমটা হয় সেটা আমি দেখব তবে আমরা চাই, জয়বাংলা ব্লাড স্কিমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সেবা দিতে, সেই অনুযায়ী আমি ছাত্রলীগের কর্মীদের নির্দেশনাও প্রদান করেছি।’

শুধু আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদেরই কেন তালিকা করা হচ্ছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিভাগকেন্দ্রিক করারও আমাদের প্ল্যান আছে। বিভাগ থেকে শুরু করে হলে যত শিক্ষার্থী থাকেন, সবার তালিকা আমরা করব। এইটা একটি লম্বা প্রক্রিয়া। তবে আমরা শুরু করেছি।’

এ বিষয়ে হল প্রশাসনের পদক্ষেপ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক ড. ইকরামুল হক বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী বা ছাত্র সংগঠনের অধিকার নেই হলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করা। এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো শিক্ষার্থী বা হল প্রাধ্যক্ষ অভিযোগ দেয়নি। যেহেতু বিষয়টি আমি শুনেছি, এ নিয়ে প্রাধ্যক্ষ পরিষদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব বলে জানান তিনি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম সাউদ এ বিষয়ে বলেন, ‘হলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সার্বিক দায়িত্ব হল প্রশাসনের হাতে। জয়বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে ছাত্রলীগের রুম ওয়ার্কের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি এ বিষয়ে হল প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব এবং পরবর্তী মিটিংয়ে আলোচনা তুলব। কোনো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য জানার অধিকার আমাদের কারোর নেই, তবে যদি কারো তথ্য জানার থাকে, তাহলে হল প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে সে জানতে পারে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close