reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৫ মে, ২০২২

রফিকুল নাজিমের হাসির গল্প

ভূতের পাঁচালি

০১.

‘কয়দিন ধইরা আবার জিনিসটা ফিরা আইছে। যারে সামনে পাইতাছে তারে ঐ নাকি জ্বালাইতাছে।’- চায়ের কাপে চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ করতে করতে কথাগুলো বলল কাসেম আলী। তালতলী বাজারের সবজিপট্টির শেষ মাথায় তার দোকান। সকাল থেকেই বাজারের লোকজন তার দোকানে চা-নাশতা করতে আসে। কথাটা শুনেই সবাই তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চায়ে দীর্ঘ এক চুমুক দিয়ে ফজর আলী জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে কাসু, আবার কি অইলো? কেডা আইলো? খুইল্লা ক দেহি।’ এক মনে কাসেম চুলায় কাঠের টুকরো দিচ্ছে। চুলার আগুনটাকে উসকে দিয়ে বলল, ‘কেরে? কিছু হুনো নাই?’ দোকানে সুনসান নীরবতা নেমে এলো। সবাই কানটা পেতে রাখল কাসেমের ঠোঁটের দিকে। কথাটা শোনার কৌতূহলে কারো কারো আঙুলেই বিড়ি পুড়ছে, কারো কারো গরম চায়ের কাপেও নেমে এসেছে হিমালয়ের বরফ শীতলতা!

হারাণ মাঝি অধৈর্য্য হয়ে ধমকের স্বরেই বলল, ‘কাসু, এইডা তোর বদণ্ডঅভ্যাস। গল্প শুরু কইরা জিরাইয়া জিরাইয়া কতা কছ। তাড়াতাড়ি ক তো দেহি; কি অইছে? নাইলে আমি ঘাটে যাই।’ এবার বিরক্তি নিয়ে কাসেম হারাণ মাঝির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধুর মিয়া, বহো। কইতাছি।’ এবার সবাই আড়মোড়া দিয়ে বসল। ‘গতকাইল রাইতে রমিজ মিয়ারে ভূতে ধরছিল। ভোর রাইতে আজানের সময় আমি পিশাব করতে বাইর হইছিলাম। করুণ একটা গোঙানির শব্দ হুইন্না ভয় পাইয়া গেছিলাম। দৌড়াইয়া কুনুরহম জানডা লইয়া ঘরে গিয়া পড়ছি। তোমগো বউয়ের চিৎকার হুইন্না বাড়ির বেকতে উইঠ্যা পড়ল। পরে সবার সঙ্গে আমিও কুপিবাতিডা লইয়া সামনে গিয়া দেহি ছাইয়ের পাড়াত রমিজ মিয়া চিত হইয়া পইড়া আছে। বেঘোরে গোঙাইতাছে। কি যে ভয়ংকর দৃশ্য! আল্লায় বড়ই বাঁচান বাঁচাইছে রমিজরে’- একটা গভীর নিঃশ্বাসে ফেলে একটু থামে কাসেম।

রাজমিস্ত্রি আবুল বেঞ্চ থেকে পা নামিয়ে বলল, ‘গত পোরকা নাকি পুবপাড়ার কলিমুল্লা চাচারেও রাইতে আটকাইছিল। এক পাও নাকি গাবগাছটার আগায়, আরেক পাও নাকি মাটিত আছিল। কল্লিমুল্লা চাচারে কইছিল ঠ্যাংয়ের নিচে দিয়া যাইতে। কলিমুল্লাও চাচায় তো কম জানা লোক না! সুরা কিরাত পইড়া ফুঁ দিছে পরে নাকি তারে ছাড়ছে।’

‘হ, গেল বছর ছনু পাগলা ট্রাক একসিডিন্টে মরার পরেত্তে এই জায়গাডা দূষিত হইয়া গেছে। কবিরের মুরগির ফারোমের পর থেইক্কা ছনু পাগলার কবর পর্যন্ত কি ঘুটঘুইট্টা আন্ধাইর রে বাবা! গাবগাছের তলাটা আরো ভয়ংকর। দিনের বেলায়ও যাইতে গাও কাঁটা দিয়া ওঠে। হুনছি একসিডিন্টে মানুষ মরলে নাকি ভূত হইয়া আহে। ছনু মিয়া তাইলে হাচা ওই ভূত হইয়া গেছে’- হারাণ মাঝিও গল্পে শরিক হয়। এবার ফজর আলী সবাইকে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় এবং রমিজ মিয়ার সর্বশেষ খবর জানতে চায়। এমন সময় কাসেমের দোকানে আসে মেম্বার সাহেব। চেয়ার টেনে বসতে বসতে তিনি বললেন, রমিজ মিয়ার অবস্থা খুব একটা ভালা না। রমিজরে পানিতে বড়ইপাতা, নিমপাতা দিয়া গরম পানি দিয়া গোসল করাইছে। দাওয়ের আগাত নুন লইয়াও খাওইছে। তবু তার রাইতের ব্যাপারটা যাইতাছে না। খালি কয় পাঁচটা পোলা নাকি তারে মারছে। ছায়ার মতন নাকি পোলাগুলা আইয়া খুব জোরে জোরে মারছে! কও তো দেহি বেকতে কয় তারে ভূতে ধরছে। হারাণ মাঝি গলাটা একটু উঁচু করে বলল, ‘মেম্বার সাব, গতকাইল রাইতে তো রমিজ মিয়ারে আমি নদী পাড় করছি। মাউরা বাইত গিয়া মনে হয় খুব বেশি মাল খাইছিল। হাতেও একটা বোতল আছিল।

০২.

দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে রমিজ মিয়ার বাড়িতে। তিন বন্ধু-বিটুল, তমাল, শরীফও বড় মসজিদের হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার বিখ্যাত ঘুষখোর ও কুখ্যাত বিচারক রমিজ মিয়াকে দেখতে গিয়েছে। মওলানা সাহেব পড়াপানি দিয়েছে। রমিজ মিয়ার বাড়ির চারদিকে ঘুরে ঘুরে তিনি কীসব পড়ে টড়ে ফুঁ দিয়েছেন। বিটুলরা অনেকক্ষণ ওই বাড়িতে ছিল। বিটুল রমিজের সামনেই লুঙ্গির কোঁচর থেকে এক শ টাকার একখানা নোট বের করে হুজুরের হাতে দিল আর বলল, ‘হুজুর, জোহরের নামাজের পর রমিজ দাদার লাইগ্গা মসজিদে মিলাদ ও দোয়া পড়াইয়েন। আমরা জিলাপি আর আগরবাতি লইয়া আমু নে।’

গতকাল সন্ধ্যাতেও রমিজ মিয়া সালিস বৈঠকে দুই নম্বরি করেছে। রহিমের কাছ থেকে পনেরো শ টাকা খেয়ে তার পক্ষে মিথ্যা রায় দিয়েছে। উপরন্তু নিরাপরাধ করম আলীকেই বর্বরভাবে অপমান করল। করম আলী শিশুর মতো বুকে চাপড় দিয়ে বিলাপ করছিল! আর দুহাত ওপরে তুলে আল্লাহর কাছে নালিশ করেছিল। অন্যায়ের বিচার চেয়েছিল সে।

গ্রামের সবার মুখে একই কথা, রমিজকে ভূতে ধরছে। একেকজন একেকভাবে গল্পটা রসিয়ে কষিয়ে বলছে। তবে অনেকে খবরটা শুনে মনে মনে খুশিও হয়েছে। বিটুলরা করম আলীর খুপরি ঘরে ঢুকে বলল, ‘দেখছো চাচা, আল্লার মাইর শেষ রাইতে। তুমি নগদে বিচার পাইলা। তমাল, ট্যাহাগুলা আমার কাছে দে। এই ধরো, এহানে পনেরো শ ট্যাহা আছে। রাখো। আবার ইস্কুলের সামনে তুমি ঝালমুড়ি বেচবা। আমগোরে মাঝে মাঝে একটু বেশি খাওয়াইয়ো কিন্তু।’ টাকাটা হাতে নিতেই করম আলীর চোখটা ছলছল করে উঠল। তবে মুহূর্তেই শামুকের মতো কান্নাটা লুকিয়ে করম আলী মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘বাজানরা, হুনলাম ভূত নাকি পাঁচটা আছিল? তয় এহন বাকি দুইটা কই?’ শরীফ বুদ্ধিজীবীর মতো উত্তর দিল, ‘চাচা, রুমেল আর শাহিন ভূতের কথা হুনলে ডরায়....! কথাটা শেষ হতেই না হতেই সবার হাসির শব্দে করম আলীর খুপরি ঘরটা কেঁপে উঠল। ভৌতিক ব্যাপার স্যাপার...।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close