reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০১ এপ্রিল, ২০২৪

তিন স্বপ্নবাজের গল্প

জীবনে চলার ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থ হয়েও তারা দমে যাননি। বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণ কিংবা বেকারত্বের ব্যাকরণ থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে নতুন উদ্যমে শুরু করেন স্বপ্নপূরণের যাত্রা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) এমনই তিনজন মেধাবী স্বপ্নবাজ তরুণ হামিদুর রসুল নয়ন, মোছা. মুর্শিদা খাতুন ও সরোয়ার জাহান রাহাতের ব্যর্থতা ও সফলতার গল্প লিখেছেন মো. আশিকুজ্জামান

হামিদুর রসুল নয়ন

কৃষিশিক্ষা আমার ধমনির স্পন্দন। কৃষিকে আমি মন থেকে ধারণ করি, ভালোবাসি। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি এক শীতের সকালে তল্পিতল্পাসহ এক বুক আশা নিয়ে বাকৃবির সবুজ চত্বরে আমার আগমন। নতুন বন্ধুদের নিয়ে কৃষি অনুষদ থেকে শুরু করে জব্বারের মোড়, নদের পাড়, আমবাগান, কে. আর মার্কেট, বঙ্গবন্ধু চত্বর, ক্লাস শেষে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে হলে ফেরা- সব স্মৃতি আজও জীবন্ত। কর্মজীবনের যান্ত্রিকতায় বাকৃবির স্মৃতিগুলোই কিছুটা স্বস্তি দেয়। মন তখন ফিরে যায় বয়স একুশে।

তবুও বাকৃবি আজীবন থাকার জায়গা নয়। বাকৃবি হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-কষ্টের স্মৃতি হিসেবেই একদম ঠিকঠাক। বাকৃবিতে আসার আগে মাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার ছেলে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ব্যর্থতা পিছু নিলে কি আর সফল হওয়া যায়? ৪১তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডার হওয়ার আশায় বুক বাঁধি। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মৌখিক পরীক্ষায় দিয়ে কোনো গতি করতে পারিনি। মনের ক্ষোভে ফেসবুকে লিখেছিলাম ‘জন্ম আমার আজন্ম পাপ’। এর মাঝে জনতা ব্যাংকে অফিসার পদে চাকরি হয়। এ যেন হালে পানি পাওয়া। ক্যাডার হতে না পারলেও বেকারত্বের গ্লানি থেকে তো মুক্তি পেলাম।

কিন্তু ক্যাডার হওয়ার আক্ষেপ রয়েই গেল। নতুন উদ্যমে আবারও ৪৩তম বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করি। এবার আর আল্লাহ আর নিরাশ করলেন না। কষ্টের ফল হিসেবে ৪৩তম বিসিএসে কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। স্বপ্নপূরণের আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছিলাম আর বলেছিলাম এবার তোমার গর্ব হয়েছি মা।

মোছা. মুর্শিদা খাতুন

বাড়ি থেকে অনেক দূরের বাকৃবি ছিল আমার কাছে অজানা এক গন্তব্য। হাজার হাজার অপরিচিত মানুষের ভিড়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধাই হয়েছিল। কিন্তু দিনশেষে আজ এই বাকৃবিই আমার আরেকটি ঠিকানা, আরেকটি পরিবার।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাকৃবির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সারা দিনের একটানা ক্লাস, ল্যাব, ব্যবহারিক, ব্রহ্মপুত্র নদ, রেললাইন, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বঙ্গবন্ধু চত্বর, পালতোলা নৌকা, আমবাগান, জব্বার, কে. আর মার্কেট- এসব কিছুর সঙ্গে কবে যে সখ্য তৈরি হয়েছে, তা বুঝতেই পারিনি।

কথায় বলে মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। ক্যাম্পাসে আসার পরে আমার স্বপ্নের ঝুলিতে যুক্ত হয় নতুন একটি শব্দ ‘বিসিএস’। সিনিয়র ভাইয়া-আপুদের থেকেই বিসিএস সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তদাতাদের সামাজিক সংগঠন বাঁধনের কাজ করার মাধ্যমেই বুঝতে পারি দেশ ও সমাজের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে।

বুঝতে পারলাম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সেই দায়বদ্ধতা মেটানো সহজ হবে। স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষ থেকে বিসিএসের জন্য পড়াশোনা শুরু করি। তবে দুর্ভাগ্য চরমভাবে পিছু নিল। ৪০তম বিসিএসে প্লিলিমিনারিই পাস করতে পারিনি। তাই বলে চেষ্টা বাদ দিইনি। ৪১তম বিসিএসেও ক্যাডার হতে পারিনি। বিসিএস আসলে যতটুকু মেধার পরীক্ষা, তার চেয়েও অনেক বেশি ধৈর্যের পরীক্ষা। তাই ধৈর্য হারায়নি কখনো। ৪৩তম বিসিএসে আল্লাহর অশেষ দয়ায় বিসিএস (মৎস্য) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই।

আমার বাবা সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন আমি যেন ক্যাডার হয়ে দেশ ও দশের সেবা করতে পারি। তবে মনে আজন্ম আক্ষেপ থাকবে কারণ আমার বাবা আমার এই সাফল্য নিজ চোখে দেখে যেতে পারেননি। ৪৩তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশের দিন মা ও ভাইয়ের মুখে যে খুশির ঝলক দিখেছি কোটি টাকা দিয়েও সেটি কেনা যাবে না।

সরোয়ার জাহান রাহাত

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের পরেই তকদিরে দেখা মিলে বিসিএস নামক সোনার হরিণের। তবে আমার জন্য একটু বেশিই কঠিন ছিল। রুটিনমাফিক জীবন, পড়াশোনা কোনোটাই ঠিকভাবে হতো না। ২০১৯ সালের এপ্রিলে বাকৃবির কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করি। কিন্তু এবার টনক নড়ল। একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা। স্নাতক শেষ কত দিন আর বেকার থাকব।

হলের বড় ভাইদের দেখতাম বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে, অনেকে ক্যাডারও হয়ে যেতেন। বেকার তো আর থাকা যাবে না, সেই চিন্তা থেকেই সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়ে।

প্রস্তুতি শুরুর পর সর্বপ্রথম ৪১তম বিসিএসের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাই। প্রথম ভালোবাসার মতোই এটিকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে দিন-রাত এক করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু হুট করে চাইলেই তো আর সব পাওয়া যায় না। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করলেও ৪১তম বিসিএসে আমার আর ক্যাডার হওয়া হয়নি। চাইলেই হতাশ হতে পারিনি। কারণ বাবা-মায়ের ভরসা ও অনুপ্রেরণার হাত তখন আমায় শিশুর মতো আগলে রেখেছিল। তাদের জন্যই উদ্যম হারাইনি। সোনালী ব্যাংক অফিসার পদে চাকরি হলে আমার নামের পাশে থেকে বেকার শব্দটি চিরতরে আড়াল হয়ে যায়। তবুও বিসিএস উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা ছাড়িনি। আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবানি ও বাবা-মায়ের দোয়ায় ৪৩তম বিসিএসে বিসিএস (কর) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। আরো একটি কথা নিঃসন্দেহে বলতেই হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেছি, তাই আমার এ সাফল্যে দেশ ও জনগণের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। দেশের ও সমাজের প্রতি আমার যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, যতটুকু পারি তা পূরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close