তাসনিম হাসান মজুমদার, চট্টগ্রাম কলেজ

  ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

নীলগিরিতে ইংরেজি বিভাগ পরিবার

বাংলাদেশের স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী একটি কলেজের নাম চট্টগ্রাম কলেজ, যা ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো চট্টগ্রাম কলেজ, ইংরেজি বিভাগ পরিবার। ইংরেজি বিভাগ ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯১৯ সালে অনার্স কোর্স চালু হয়। ইংরেজি বিভাগে পাঠদানের পাশাপাশি নিয়মিত পাঠক্রমবহির্ভূত নানা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা প্রদর্শনী ও সবচেয়ে উত্তেজনকর শিক্ষা সফরের মধ্যে অন্যতম।

নানা কার্যক্রমের মাঝে এবার সময় হলো, শিক্ষা সফরে যাওয়ার। আমাদের বিভাগের একটি প্রথাগত নিয়ম হলো যারা মোস্ট সিনিয়র তারা শিক্ষা সফর আয়োজন করে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায়, ২০২৪-এ কোথায় শিক্ষা সফরে যাওয়া যায় তা নিয়ে শুরু হলো মতামত সংগ্রহ। বিভিন্ন বর্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার মতামত দিচ্ছিল। কেউ প্রস্তাব দিচ্ছিল রাঙ্গামাটি যাওয়ার। কেউ চাচ্ছিল কক্সবাজার যেতে। আবার কিছুসংখ্যক ছিল সেন্টমার্টিন যাওয়ার পক্ষে। আমরা ৯৯তম ব্যাচ অনার্স চতুর্থ বর্ষের বন্ধুরা প্রস্তাব দিলাম নীলগিরিতে যাওয়ার জন্য। কারণ ২০২৩ সালে আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম। সে জন্য সমুদ্রের পরে পাহাড় ভ্রমণে গেলে জিনিসটা দারুণ হয়। আমরা জানি, পাহারা সমুদ্র তারা দুজন দু-বিন্দুর হলেও তাদের মধ্যে দূরত্বটা খুব বেশি নয়। সাগরের কূল ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে থাকে সু-উচ্চ বিশাল পাহাড়-পর্বত। সে জন্য সমুদ্র স্নান শেষে পাহাড় ট্র্যাকিংয়ে গেলে মন্দ হয় না।

যাই হোক, পরে আমাদের চতুর্থ বর্ষের বন্ধুদের কথায় গৃহীত হলো। স্থান নির্ধারণ করা হলো বান্দরবান জেলার সুন্দরতম জায়গা নীলগিরি, চিম্বুক পাহাড় ও শৈলপ্রপাত। নীলগিরি বান্দরবান জেলায় অবস্থিত একটি পাহাড় এবং পর্যটনকেন্দ্র। নীলগিরিকে বলা হয় বাংলাদেশের দার্জিলিং। পাহাড়টি বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়টি ২২০০ ফুট উঁচু। নীলগিরি পাহাড় চূড়াতেই রয়েছে সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্র। চিম্বুক পাহাড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০ ফুট উচ্চতায় এর অবস্থান। বান্দরবান পার্বত্য জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। চিম্বুক পাহাড় থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত খুব নয়নাভিরামশৈলপ্রপাত ঝরনা বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-থানচি রোডের পাশে অবস্থিত। বাংলাদেশে অতিপরিচিত ঝরনাগুলোর মধ্যে শৈলপ্রপাত অন্যতম।

পর্যটন নগরী বান্দরবানের কাছে হওয়ায় সারা বছরই পর্যটক সমাগমে মুখরিত থাকে স্বচ্ছ ও ঠান্ডা পানির এই ঝরনাটি। যাই হোক, এবার চোখ দেওয়া যাক শিক্ষা সফরের কথায়, আমাদের বর্ষের প্রতিনিধি ছিল বন্ধুবর হৃদয়। শিক্ষা সফরের তারিখ ছিল ৭ ফেব্রুয়ারি রোজ বুধবার। দেখতে দেখতে চলে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে কলেজ প্রাঙ্গণে সব ভ্রমণপিপাসুর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সে সময় মাথায় বিবেচনায় রেখে সবাই ধীরে-সুস্থে কলেজ প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হলাম। ৭টা ৩০ মিনিটে বাস ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বান্দরবান জেলা শহরের উদ্দেশে বাসা ছেড়ে যায় ৮টা ৯ মিনিটে। আর হ্যাঁ বলে রাখা ভালো, আমি ছিলাম ২ নম্বর বাসের যাত্রী। আমাদের দুই নম্বর বাস ছেড়ে যাওয়ার আগে বাসে এসে উপস্থিত হন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবু তাহের স্যার। তিনি আমাদের বান্দরবান নীলগিরিতে গিয়ে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, এসব বিষয়ে নির্দেশনা দেন।

আমাদের দুই নম্বর বাসে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক নাজমুল হক স্যার ও প্রভাষক আলমগীর চৌধুরী স্যার। নাজমুল হক স্যারের বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পর বাস চলাকালে আমাদের শিষ্টাচার কেমন হবে। বান্দরবান গিয়ে কী করব, কী করব না, সেসব বিষয় নির্দেশনা দেন। সব শিক্ষার্থী স্যারের সঙ্গে কথা দেয় আমরা ঠিকমতো একটি সফল ট্যুর শেষ করব। দেখতে দেখতে আমরা ১০টা ২৯ মিনিটে বান্দরবান জেলা শহরে গিয়ে পৌঁছাই। সেখান থেকে আমরা চাঁদের গাড়ি করে নীলগিরির উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের এই ট্যুরের অন্যতম আকর্ষণ ছিল চাঁদের গাড়ি করে বান্দরবান জেলা শহর থেকে নীলগিরিতে যাওয়া। বান্দরবান জেলা শহর থেকে নীলগিরি যাওয়ার পথটুকুই আমরা বেশি উপভোগ করেছি। পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা, কোথাও সংকীর্ণ মোড়, সরু পথ, পাহাড়ি মানুষের জীবনযাত্রা পাহাড়ের বুকচিরে অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক ঝরনা এসব সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই কখন যে পৌঁছে গেলাম নীলগিরিতে টেরই পেলাম না।

ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১টা ৯ মিনিট। ততক্ষণে আমরা ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মলিন চেহারার একেকজন ভ্রমণপিপাসু। এরপর আমরা দুপুরের খাবার গ্রহণ করলাম। খাদ্যতালিকায় ছিল সাদা ভাত, মাছ, মুরগি, ভর্তা ও মুগ ডাল। দুপুরের খাবার শেষে টিকিট সংগ্রহ করে দৌড়ে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। আমাদের নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে দেখার সময় বেঁধে দিয়েছিল ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। আমি ও আমার বন্ধুবর আরাফাত আগেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম আমরা সবার আগে ভেতরে গিয়ে সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলোতে নিজেরা ছবি তুলব। যেই কথা সেই কাজে। ট্যুরে আমাদের সঙ্গে অতিথি গেস্ট হিসেবে ছিলেন বিভাগীয় প্রধান আবু তাহের স্যারের সহধর্মিণী। দূর থেকে লক্ষ করলাম এই বয়সেও তারা একে অন্যের প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধা সম্মান ও প্রেম-ভালোবাসার চাদরে আবৃত। বাংলাদেশের দার্জিলিংখ্যাত নীলগিরি আমি যতটা আবেগ-উচ্ছ্বাস নিয়ে গিয়েছিলাম, ঠিক ততটা আনন্দ দিতে পারেনি। কারণ নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০১৪ সালে আমি নীলগিরি ভ্রমণ করেছিলাম। ২০১৪ সালের নীলগিরির সঙ্গে ২০২৪ সালের নীল আকাশ-পাতাল ব্যবধান। ২০১৪ সালে দেখেছিলাম সবুজের সমারোহ দূরদূরান্তে নীলাভ আকাশের চাওনি। নীলগিরির বুকে ২৪-এ গিয়ে ফেলাম ইটপাথরের কটেজ, যা আমার ভ্রমণপিপাসু মনকে ভীষণ ছাড়া করেছে।

নীলগিরিতে আর সেই সবুজের সমারোহ নেই। নীলাভ দিগন্ত নেই। এখন শুধু রয়েছে ইটপাথরের কটেজ ও কনস্ট্রাকশন কাজ চলমান। যাই হোক, আমার ট্যুরের দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক। আমাদের ডিপার্টমেন্টের ট্যুরের অন্যতম একটি আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে র‌্যাফেল ড্র। এখানে প্রতিটি বাসের তিনজন করে ৯ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। আমাদের চতুর্থ বর্ষ থেকে র‌্যাফেল ড্রয়ে বিজয় হয় বন্ধু মামুন ও কানিজ। আমি বিজয়ী না হওয়ায় কিছুটা হতাশ হয়ে ছিলাম কিন্তু বন্ধুরা পুরস্কার পাওয়ায় সেই হতাশা কেটে গিয়েছিল। এরপর আসরের আজান দিলে যে যার মতো করে চাঁদের গাড়িতে ফিরে এলাম।

ততক্ষণে ৪টা বেজে ২৩ মিনিট। নীলগিরি থেকে ফেরার পথে চিম্বুক পাহাড় ও শৈলপ্রপাত দেখার কথা থাকলেও সময়ের অভাবে তা করা হয়ে ওঠেনি। ৪টা ৩০ মিনিটে চাঁদের গাড়ি বান্দরবান জেলা শহরের দিকে ছুটে চলল আপন গতিতে। আমি ড্রাইভারের পাশে সিটেই বসে ছিলাম সেজন্য আমাকে তেমন বন্ধুদের ঝুলে ঝুল কষ্ট করতে হয়নি। পাহাড়ি মানুষের বিকেলের জীবনযাত্রা ও পশ্চিম আকাশের রক্তিম সূর্যটা দেখতে দেখতে বান্দরবান জেলা শহরে এসে উপস্থিত হলাম। ততক্ষণে দিনের আলো নিভে গিয়ে জেলা শহরের সন্ধ্যা নেমেছে। এখানে ছোট্ট একটা চা বিরতি ছিল। স্যারদের সঙ্গে চায়ের আড্ডা মেতে ছিলাম আমরা, আমি, তাসনিম, বন্ধু সিফাত, আরিফ, তুষার, সাফওয়ান হৃদয়, রাফসাল ও অন্যরা। চা আড্ডা শেষে এবার বাড়ি ফেরার পালা। বাসে চেপে বসলাম চট্টগ্রাম কলেজের উদ্দেশে। ট্যুরের স্পটগুলোর থেকেও আমরা বাসে বেশি আনন্দ করেছি। যে যার মতো করে খোশগল্প, হাসি-তামাশা, গানের তালে তালে নৃত্য সবকিছুই ছিল স্মৃতিময়। ৯টা ২৩ মিনিটে বাস এসে থামে চট্টগ্রাম কলেজের প্রধান ফটকে। তারই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে চট্টগ্রাম কলেজ, ইংরেজি বিভাগ ২০২৪ সালের নীলগিরি ভ্রমণ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close