অনিল মো. মোমিন

  ০১ মে, ২০২৪

শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে নিবেদিত আঁচল ফাউন্ডেশন

গ্রামে কলেজের পাঠ চুকিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসে রূপন্তি। কিন্তু যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা নিয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। কিছুদিন পর থেকেই তা ভাটা পড়ে বিষণ্ণতা জায়গা করে নেয় সেখানে। কোনো আড্ডায় কিংবা আয়োজনে তার সঙ্গে অন্যদের একটা স্পষ্ট ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। ফলে গ্রামের দুরন্ত, হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটি ক্রমেই নিজের ভেতর গুটিয়ে যায়। হতাশাগ্রস্ত রূপন্তি মানসিক অবনতি ঘটতে থাকে। অর্ণব নামের এক কিশোর দিনের প্রায় পুরোটা সময় থাকে টিকটকে। বাছবিচারহীন সবকিছু নিয়েই মাতামাতি তার। রূপন্তি কিংবা অর্ণবদের মতো মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির এমন অসংখ্য ঘটনা আমাদের নিত্যদিনের চোখের সামনে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জীবনে বিভিন্ন অসুস্থতার মতো মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিও ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। জীবনের গতি বাড়ার সঙ্গে আবেগ সম্পর্কিত নানা মানসিক সমস্যা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলছে। দেশে বিষয়টিতে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের সঠিক ধারণা থাকলেও অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞতা, কুসংস্কার কিংবা ভ্রান্ত ধারণার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যথেষ্ট সচেতন নন। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন কাজ করছে তাদেরও বহু বেগ পেতে হচ্ছে। প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা মাড়িয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে একটি সংগঠন- ‘আঁচল ফাউন্ডেশন।’ ‘You Always Matter’ মোটো ধারণ করে সংগঠনটি শিক্ষার্থীসহ তরুণ যুবাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় সচেতনতা বৃদ্ধি, এ সংক্রান্ত নানা ট্যাবু ভাঙন এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করাসহ তরুণদের নানা দক্ষতা বৃদ্ধিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে।

ঢাবি শিক্ষার্থী তানসেন রোজের হাত ধরে ২০১৯ সালে গড়ে ওঠে আঁচল ফাউন্ডেশন। তরুণ তানসেন রোজের মাথায় সংগঠন গড়ার মূল প্রভাবক ছিল তার ডিপার্টমেন্টের তিন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনা। প্রিয় সহপাঠীরা কী ভয়ানক মানসিক পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছা মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন- এমন ভাবনা তাকে কুড়ে কুড়ে খেত। সিদ্ধান্ত নেন মানুষের জন্য কাজ করবেন। বৃহৎ পরিসরে কাজের চিন্তা থেকে সংগঠন গড়ার করা ভাবেন। যার মধ্য দিয়ে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়াদি এবং তাদের বিভিন্ন দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করা হবে। জাবিতে পড়ুয়া বন্ধু রাফিয়া তাসনিম রিফাকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল আঁচল ফাউন্ডেশনের শুভ সূচনা করেন। মায়ের আঁচল যেমন তার সন্তানকে আগলে রাখে, তেমনি আঁচল ফাউন্ডেশন তার ছায়াতলে আসা সব তরুণকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে- এমন প্রত্যয় ও বিশ্বাসে যাত্রা শুরু করে এখন অবধি নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

আঁচল ফাউন্ডেশন কর্তৃক মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পরিচালিত বিভিন্ন জরিপ, সেসবের ফলাফল এবং তার প্রেক্ষিতে করণীয় নিয়ে ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব ফেলেছে। এখন চলছে ২০২৪ সাল। দেখতে দেখতে পাঁচ বছরে পদার্পণ করা আঁচল ফাউন্ডেশন এখন যেন সত্যি সত্যি মানসিক স্বাস্থ্যে মায়ের আঁচলের মতোই নির্ভার ছায়া ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। নিঃসন্দেহে আঁচল ফাউন্ডেশন বর্তমানে দেশবাসীর মনে একটি আস্থার জায়গা দখল করে নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদের মতে, প্রতিষ্ঠা থেকে আঁচল ফাউন্ডেশন গবেষণামূলক বেশ কিছু সমীক্ষার কাজ করেছে। মাধ্যমিক তথ্য-উপাত্ত এবং কিছু জরিপের মাধ্যমে তারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছেন। তাদের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান তারা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে খবরের ভিতরে খবর আমাদের কাছে তুলে ধরছে। মানসিক স্বাস্থ্যের অনেক বিষয় আঁচল ফাউন্ডেশন সবার সামনে তুলে এনেছে যা পরে বিভিন্ন মহলে আলোড়ন তুলেছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো জানাতে পেরেছে।

মানসিক সুস্থতা, হতাশায় সহায়তা ও সচেতনতা বাড়াতে আঁচল ফাউন্ডেশন তার প্রথম কর্মসূচি শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে আত্মহত্যা রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা ছাড়িয়ে আঁচল ফাউন্ডেশন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেমন- ইডেন কলেজ, হোম ইকোনমিক্স কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতে কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে। ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য ও কাজের জন্য আঁচল ফাউন্ডেশনে বর্তমানে মোট ২৩টি ইউনিট ও অধ্যায় রয়েছে। এ যাবৎ পর্যন্ত আঁচল ফাউন্ডেশন মানসিক স্বাস্থ্য ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নানাবিধ কাজ করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :

> BYLC Youth Carnival বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, ‘টেল ইওর আনটোল্ড স্টোরিজ’, ‘আঁচল আড্ডা’, ‘লাইটেন আপ দ্য মুড’ ইত্যাদির মতো অনলাইন প্রোগ্রামের মাধ্যমে তরুণদের তাদের উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করার উদ্যোগ নিয়েছে।

>তরুণ যুবা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়া ক্যারিয়ার হতাশা এবং জীবন ঝুঁকি হ্রাসে কাউন্সিলিং সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।

>বুটক্যাম্প, ইয়ুথ কার্নিভাল, মনস্তাত্ত্বিক অলিম্পিয়াড, গ্রামীণ এলাকায় মানসিক স্বাস্থ্য শিবির এবং শূন্য আত্মহত্যার হারের লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত একাধিক জাতীয় প্রকল্পের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে।

>বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা তুলে ধরতে আঁচল ফাউন্ডেশন এখন পর্যন্ত ১৪টি জরিপ পরিচালনা করেছে। এসব সমীক্ষার ফলাফল শতাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিউজ পোর্টাল এবং টিভি চ্যানেল গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে।

আঁচল ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে বেশ কিছু উদ্যোগ। সভাপতি তানসেন রোজ জানান, ‘২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা, মানসিক বিশেষজ্ঞ বৃদ্ধির জন্য সেন্টার ফর মেন্টাল হেলথ স্টাডিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো, স্কুল-কলেজগুলোতে আঁচল ফ্লোরা নামে মেন্টাল হেলথ কর্নার চালু করা, স্কুল কলেজগুলোথে মেন্টাল হেলথ ফাস্ট এইডার তৈরি করা, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করতে মেন্টাল হেলথ রিসার্চ সেন্টার খোলা হবে। এছাড়া হটলাইন নম্বর চালু, শিক্ষার্থীদের সহনশীলতা বাড়াতে বিভিন্ন ক্যাম্প পরিচালনা করাসহ বেশ কিছু উদ্যোগ পরিকল্পনায় আছে।’

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত সচেতনতার বিষয়ই নয় বরং এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে নানা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রচার-প্রসারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কমিউনিটি গড়ে তুলতে আঁচল ফাউন্ডেশন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঘিরে থাকা অজ্ঞতা কাটিয়ে তরুণদের পূর্ণ বিকাশে সাহায্য করতে আঁচল ফাউন্ডেশন বদ্ধপরিকর।

অধ্যাপক কামাল উদ্দিনের ভাষায়, শিক্ষার্থীদের হতাশা, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যা, আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদিতে সংখ্যাগত যে তথ্য আঁচল ফাউন্ডেশন দিচ্ছে সেটা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করার জন্য যথেষ্ট, সবাইকে সচেতন করার জন্য যথেষ্ট। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিদ্যমান উদাসীনতা এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট কাজ যে হচ্ছে না তা আঁচল ফাউন্ডেশন এড্রেস করতে পেরেছে। এর কাজের ফলে মানুষ বিষয়গুলো জানছে এবং বুঝতে পারছে এখানে কিছু করা উচিত। কাজ করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও একটা বাড়তি চাপ পাচ্ছে।

বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত এবং স্বাস্থ্যকর সামাজিক পরিবেশের স্বপ্ন লালন এবং তা বাস্তবায়নে অবিরাম কাজ করে আঁচল ফাউন্ডেশন। আঁচল ফাউন্ডেশন মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আশার বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সচেতনতা বাড়ানো, সমর্থন প্রদান এবং পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন করার জন্য তাদের অবদান ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

লেখক : এক্সিকিউটিভ মেম্বার, আঁচল ফাউন্ডেশন

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close