মো আমান উল্লাহ, বাকৃবি

  ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

বাকৃবির গবেষণা

উচ্চ ফলনশীল সরিষার নতুন জাত উদ্ভাবন

স্বল্পমেয়াদি, উচ্চফলনশীল, রোগবালাই প্রতিরোধী এবং লবণাক্ততাসহিষ্ণু নতুন সরিষার জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। নতুন উদ্ভাবিত জাতটির নামকরণ করা হয়েছে বাউ সরিষা-৯, যা এ বছরের ৩১ মার্চ জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে নিবন্ধন পেয়েছে। নতুন এ জাতটির উৎপাদনকাল ৭৮ থেকে ৮২ দিন এবং বীজে তেলের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা দেশে প্রচলিত সরিষার সাধারণ জাতে প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ। উদ্ভাবিত জাতটি থেকে আড়াই কেজি সরিষা থেকে ১ লিটার তেল পাওয়া যাবে। জাতটির হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ২ টন, যা প্রচলিত অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি সরিষার জাত থেকে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ বেশি।

উদ্ভাবিত বাউ সরিষা-৯ ছাড়করণ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসয তথ্য জানান জাতটির উদ্ভাবক ও প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. এ বি এম আরিফ হাসান খান রবিন। এ ছাড়া গবেষণা সহযোগী হিসেবে ছিলেন ওই বিভাগের একাধিক স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী। বুধবার (২৪ এপ্রিল) সকাল ১০টায় কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগে গবেষকের অফিস কক্ষে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে গবেষক জানান, বাউ সরিষা-৯ চাষের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, অল্টারনারিয়া ব্লাইট, পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণ খুবই কম। জাতটি পরিমিতরূপে বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু হওয়ায় উৎপাদন প্রচলিত অন্যান্য জাতের তুলনায় প্রায় ২০-২৫ শতাংশ বেশি। কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজননের গবেষণা মাঠ এবং বাকৃবির পাশর্^বর্তী ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় জাতটির পরীক্ষামূলক চাষ করে আশানুরূপ ফলন পাওয়া গিয়েছে। উদ্ভাবিত বাউ সরিষা-৯-এ অলিক অ্যাসিডের পরিমাণ শতকরা ১৬-১৭ শতাংশ, ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের অনুপাত ২৫ : ১, যা সয়াবিন তেলে ১৮ : ১। বাউ সরিষা-৯ থেকে প্রাপ্ত তেলের স্মোক পয়েন্ট ২৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, যা সয়াবিন তেলের তুলনায় প্রায় ১৪ ডিগ্রি বেশি। সরিষার তেলে বিদ্যমান গ্লুকোসিনোনেট বিশ্লেষিত হয়ে আইসো থায়োসায়ানাইট তৈরি হয়, যা ক্যানসারপ্রতিরোধী। ফলে, ভোজ্য তেল হিসেবে বাউ সরিষা-৯ সরিষার তেল সয়াবিন তেলের তুলনায় অধিক স্বাস্থ্যসম্মত।

গবেষক আরো জানান, দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়। মোট উৎপাদিত সরিষার তেলের বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এই উৎপাদন দ্বারা দেশের মোট ভোজ্য তেলের চাহিদার মাত্র ২০-৩০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়। এ কারণে প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকার সরিষা, সয়াবিন এবং পাম তেল আমদানি করতে হয়। দেশীয় প্রক্রিয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ৪০ শতাংশ ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় বাউ সরিষা-৯ জাতটি চাষে দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণ করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় করা সম্ভব হবে। প্রচলিত অন্যান্য সরিষার জাতের তুলনায় বাউ সরিষা-৯ চাষে হেক্টরপ্রতি প্রায় ২৪ হাজার টাকা বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে। সে হিসাবে বছরে ২৪ বিলিয়ন টাকার সরিষার বাজার তৈরি করা সম্ভব। পাশাপাশি জাতটি স্বল্পমেয়াদি হওয়ায় আমন এবং বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে এটি চাষ করা যাবে। ফলে একই জমিতে বছরে চারটি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে, যা ফসলের নিবিড়তাও বৃদ্ধি করবে।

উদ্ভাবিত জাত সম্পর্কে গবেষক বলেন, বাউ সরিষা-৯ ব্রাসিকা ন্যাপুস প্রজাতির যাদের জীবনকাল গড়ে ৮০ দিন। কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের সংরক্ষিত ২৫০টিরও অধিক জেনোটাইপের মধ্য থেকে স্বল্প জীবনকালীন পাঁচটি জেনোটাইপ প্রজাতিভেদে বাছাই করা হয়। পরে জেনোটাইপগুলোর ডায়ালাল মেটিং পদ্ধতিতে উচ্চতর গবেষণা করে বাউ সরিষা-৯ স্বল্পজীবনকালীন প্রজাতিটির উদ্ভাবন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) তিনটি প্রকল্পের আওতায় ২০১৮ সাল থেকে সাত বছর যাবৎ এই জাতটি উদ্ভাবনের গবেষণা করা হয়েছে। প্রকল্প তিনটি হলো, জার্মপ্লাজম এনহ্যান্সমেন্ট অ্যান্ড জেনেটিক পিউরিটি ফর বায়োটিক স্ট্রেস রেজিজটেন্স অ্যান্ড শর্ট ডিউরেশন ইন রাপসিড অ্যান্ড মাসটার্ড, ডায়ালাল মেটিং ইন ওয়েল সিড ব্রাসিকা জেনোটাইপস টু সিলেক্ট ফর শর্ট ডিউরেশন অ্যান্ড এবায়োটিক স্ট্রেস টলারেন্স লাইনস ফ্রম এফ-২ পপুলেশন এবং সিলেকশন ফর শর্ট ডিউরেশন, অল্টারনারিয়া ব্লাইট অ্যান্ড স্যালিনিটি স্ট্রেস টলারেন্স ইন দ্য অ্যাডভান্সড ব্রিডিং লাইনস অব রাপসিড অ্যান্ড মাস্টার্ড। প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রগুলো ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বিশিষ্ট জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বর্তমানে জাতটির অধিকতর উৎকর্ষ সাধনে উচ্চতর গবেষণা চলমান রয়েছে এবং আরো কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close