আজিজ ওয়েসি, চবি

  ২৯ এপ্রিল, ২০২৪

ভাটি বাংলার পাবলিকিয়ানদের একটি সুন্দর দিন

‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি হোক ভাটি বাংলার উন্নয়নের হাতিয়ার’ সংগঠনটির মূলমন্ত্র। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল থেকে প্রতি বছরই শত শত শিক্ষার্থী বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেমন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায়। হাওরাঞ্চল তথা ভাটি বাংলার এই শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ সুনামগঞ্জ’ যা সংক্ষেপে পুসাস নামে পরিচিত। সংগঠনটি প্রতি বছরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়া এসব শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা প্রদান করে থাকে। তাই প্রতি বছরের মতো এবারও আয়োজন করা হয়েছিল একটি আনন্দঘন সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠান।

গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহের একটি দিন। এমন দিনে পানির পিপাসায় দেহ মন কাতর হয়ে থাকে। এ রকম একটি দিনে একঝাঁক পাবলিকিয়ানদের মিলনমেলা যেন হাওরের শীতল বাতাসের মতোই দেহ মন শীতল করে দিয়েছিল। আমরা মিলিত হয়েছিলাম সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির হাসন রাজা মিলনায়তনে। আমার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে অবস্থিত এই মিলনায়তন। এত দূরত্ব হওয়া সত্ত্বেও আমি বাতাসের বেগে ছুটে গিয়েছিলাম এই মিলন মেলায় অংশগ্রহণ করতে। কারণ সেখানে ভাটি বাংলার পাবলিকিয়ানদের সঙ্গে আরো জ্ঞানী-গুণিজনদের সান্নিধ্যে উপভোগের সময় অতিবাহিত করা যায়। তাই গ্রীষ্মের সকালে বাড়ি থেকে রওনা হলাম আমি ও আমার বন্ধু কবির। আমরা দুজনে বাংলাদেশের স্বনামধন্য দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। আমি পড়াশোনা করছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে এবং কবির পড়াশোনা করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে।

সকালবেলা নাশতা সম্পন্ন করে আমরা হাওরাঞ্চলের মাটির হেলিকপ্টার মোটরসাইকেলে করে যাত্রা শুরু করলাম। উভয় পাশে হাওর, মাঝখানে যোগাযোগের রাস্তা। মোটরসাইকেলে করে এমন রাস্তা পারি দেওয়া যেন হেলিকপ্টারে চড়ার অনুভূতির মতোই। যাই হোক আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা ভ্রমণ করে পৌঁছালাম সেই হাসন রাজা মিলনায়তনে। এখানে এসেই দেখা হলো দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া ভাটি বাংলার সব ভাই-বোনের সঙ্গে। এটা ছিল এক আনন্দঘন পরিবেশ। আমাদের মিলনমেলা। মরমি কবি হাসন রাজা, বাউল শাহ আব্দুল করিম, দুরবিন শাহ, সুফি সৈয়দ শাহ নূর এই বিখ্যাত ব্যক্তিরা হলেন ভাটি বাংলার মানুষের প্রাণের স্পন্দন। তাই তাদের রচিত গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটির সূচনা হয়।

শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত এই কবি-সাহিত্যিক, সুরকারদের আধ্যাত্মিক গান, কবিতা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তাই আমার মতো এই হাওরবাসীর মন মজে এই গান কবিতায়। লোকে বলে ও বলে রে ঘর বাড়ি ভালা না আমার, হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিলরে, তুমি আমার আমি তোমার এই আশা করে, আমি পাপী তুমি জামিনদার এই গানগুলোর যখন সুর ওঠে, তখন হৃদয়ে হাওরের শীতল বাতাস প্রবাহিত হয়। ভুলে যায় আধুনিক গানের কথা ও সুর। শহরের যানজট থেকে মুক্তি পাওয়ার শান্তি ফিরে পাই। আর দর্শকরা করজোড়ে হাত তালি দিয়ে আনন্দের ঝড় তোলে। গায়ক মনের মাধুরি মিশিয়ে গান গায়, কবিতা আবৃত্তি করে আর মঞ্চ কাপিয়ে তোলে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর্ব শেষ হলে দুপুর ২টায় আমরা লাঞ্চ সম্পন্ন করি। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেই। এরপরের পর্বটি ছিল আরো মনোমুগ্ধকর। আরো আকর্ষণীয়। আরো উৎসাহ অনুপ্রেরণামূলক। সময় তখন তিনটা বাজে। মঞ্চে প্রবেশ করতে শুরু করলেন অনুষ্ঠানের একদল শিরোমণি। যাদের সার্বিক সহযোগিতায় এবং উপদেশ ও উৎসাহ অনুপ্রেরণায় ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ সুনামগঞ্জ’ সংগঠনটি এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্য থেকে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি, বিশেষ অতিথি ছিলেন তারা হলেন বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি ড. সাদিক এমপি (সুনামগঞ্জ-৪), সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি সাবেক ছাত্রনেতা অ্যাডভোকেট রণজিত সরকার, সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হুদা মুকুট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক সুস্মিতা রায় এবং সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাশেদ ইকবাল চৌধুরী প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে এসব জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা হাওরাঞ্চল তথা ভাটি বাংলার শিক্ষার্থীদের প্রতি বিভিন্ন দিকনির্দেশনা, পরামর্শ, উপদেশ ও উৎসাহ অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য প্রদান করেন। যেমন : সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পরিশ্রমই হলো সফলতার মূলমন্ত্র। উৎপাদনের মূল উপাদান হলো পরিশ্রম। পরিশ্রম ছাড়া কেউ কখনো সম্পদশালী হতে পারে না। তাই তিনি সবার উদ্দেশে পরিশ্রম করার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাদিক বলেন, আমরা হাওরবাসী। আমরা ভাটি বাংলার মানুষ। তাই আমরা জাতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করব। শুধু নিজে সফল হওয়া মানেই সফলতা নয়। জাতিকে সফল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরো বলেন, মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অপব্যবহার হলো মাদকের চেয়েও ভয়ংকর। একটি মোবাইল ফোনই আমাদের ধ্বংস করতে পারে। তাই এর সঠিক ব্যবহারের জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করেন তিনি। সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট রণজিত সরকার বলেন, আমরা সবাই ছাত্র। তাই ছাত্র হিসেবে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। বাংলাদেশকে সোনার বাংলা বা স্মার্ট বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সুনামগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক বলেন, ভাটি বাংলার মানুষের উন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আগের তুলনায় আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা এখন অনেক ভালো। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন বেড়েছে। এগিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ-সুবিধা তৈরি হয়েছে। তাই আমাদের সেই সুযোগ কাজ লাগাতে হবে। না হয় সুনামগঞ্জের উন্নয়ন সম্ভব নয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক সুস্মিতা রায় ছাত্রদের ক্যারিয়ারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বেশি বেশি বই পড়ার পরামর্শ দেন। তিনি বই পড়ে প্রশ্ন করার মতো এবং চ্যালেঞ্জ করার মতো শক্তি অর্জন করতে আহ্বান জানান। এভাবে তাদের অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে ছাত্রছাত্রীরা করজোড়ে হাত তালি দিয়ে মিলনায়তন কাঁপিয়ে তোলে।

ভাটি বাংলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া শিক্ষার্থীদের প্রাণের সংগঠন, হাওরবাসীর অনুপ্রেরণার এই সংগঠনটির ঈদ-পরবর্তী এই অনুষ্ঠানের শেষ পর্বটি ছিল নব পাবলিকিয়ানদের জন্য শুভ মাহেন্দ্রক্ষণ। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে সুনামগঞ্জ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের আরো অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া নতুন শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এতে একটি আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজমান ছিল। সবার মুখে ছিল আনন্দের হাসি। হাওরাঞ্চল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। শত সংগ্রাম আর পরিশ্রমের ফসল হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেতে দিনকে রাত, রাতকে দিন বানিয়ে পরিশ্রম করতে হয়। এ যেন এক সাধনার নাম। ফলে এমন সংবর্ধনায় শিক্ষার্থীদের মনে আনন্দের জোয়ার আসে। নব নব স্বপ্নে তারা আবার জাল বুনতে শুরু করে। তারা স্বপ্ন দেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার, স্বপ্ন দেখে বড় মনের মানুষ হওয়ার, স্বপ্ন দেখে সমাজকে পরিবর্তন করার। ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ সুনামগঞ্জ’ বা পুসাসের এই একটি বিউটিফুল দিনের অনুষ্ঠানটি অয়ন চন্দ্র ভাইয়ের সভাপতিত্বে জামিল ভাই সঞ্চালনা করেছিলেন। সবশেষে আমরা একসঙ্গে ক্যামেরায় বন্দি হয়েছিলাম। এ যেন প্রমাণ করে দিল ভাটি বাংলার মানুষ সবাই মিলে একটি পরিবার। সবশেষে শিক্ষা ও সংস্কৃতি হোক ভাটি বাংলার উন্নয়নের হাতিয়ার সেই প্রত্যাশা করি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close