নওগাঁ প্রতিনিধি

  ০৪ এপ্রিল, ২০১৯

নওগাঁয় শিক্ষক বদলিতে ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ

নওগাঁয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বদলি করার নিয়ম থাকলেও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বদলি করা হয়েছে। অন্যদিকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে বদলি করা আবেদন স্বাক্ষর করাতেও শিক্ষকদের ঘুষ দিতে হয়েছে। অফিস-সহায়ক সিরাজুল ইসলামসহ বিভিন্ন উপজেলার বদলি-সংক্রান্ত দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের মাধ্যমে এ টাকা যাচ্ছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের পকেটে। শিক্ষকরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের এই অভিযোগ করা হয়েছে তা নাকচ করেছেন। তারা বলেছেন তারা শিক্ষকদের বদলি করেছেন নিয়ম মেনে, ঘুষ গ্রহণের কোনো কথা আসে না।

জানা গেছে, প্রতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত বদলি হয়ে থাকেন। আর এ বদলিতে নিয়মনীতি না মেনে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ‘২নং শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ সহকারী শিক্ষক আবদুল মতিনের বাড়ি একই উপজেলার বারাতল গ্রামে। তিনি ২০০৩ সালে উপজেলার ‘ব্যাশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ যোগ দেন। সেখানে দুই বছর অবস্থান করে ‘ভরট্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ বদলি হন। এরপর ২০১২ সাল থেকে এখন অবধি ‘২নং শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ চাকরি করছেন। গত ২ জানুয়ারি উপজেলার ‘মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ যাওয়ার জন্য আবেদন করলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সেটি গ্রহণ করেননি। জুনিয়র শিক্ষক মাকসুদা খানমকে সেখানে বদলি করা হয়েছে।

এরপর সুযোগমতো বদলগাছি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হবে বলে আবদুল মতিনকে আশ্বস্ত করেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। সেখানে তিনটি পদশূন্য রয়েছে। শূন্য পদের বিপরীতে গত ১৫ জানুয়ারি স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশ নিয়ে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন তিনি। আর এ শূন্য পদের বিপরীতে ফয়জাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষক অনিল কুমার এবং জিধিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সানিয়া মির্জাকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মার্চ মাসে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু আবদুল মতিনকে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি দেব বলে কালক্ষেপণ করেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। অপরদিকে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অপর একটি শূন্য পদের বিপরীতে গত ২৮ মার্চ গোবরচাপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে নুরুন নাহার নামে এক শিক্ষক বদলির জন্য আবেদন করলে স্থানীয়রা আপত্তি জানালে সেটি ফেরত দেয়া হয়। পরে আবারও তিনি আবেদন করলে সেটি গ্রহণ করেন শিক্ষা কর্মকর্তা। ২ মার্চ নুরুন নাহার প্রকল্প থেকে চাকরিতে যোগদান করেন।

মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষক আবদুল মতিন বার বার শিক্ষা কর্মকর্তাকে তাগাদা দিলে তার কাছ থেকে শিক্ষা কর্মকর্তার ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। দাবি করা টাকা দিতে অস্বীকৃত জানালে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে নুরুন নাহারকে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়।

২০০৯ সালে সহকারী শিক্ষক পদে নাহিদা সুলতানা নিয়োগ পেয়ে তেঘরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি কোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া জন্য এ বছর শিক্ষা অফিসে আবেদন করেন। কিন্তু তার আবেদন মঞ্জুর না করে ২০১১ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত কয়াভবানিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক উম্মে আতিয়াকে কোলা স্কুলে বদলি করা হয়।

গয়েশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহমুদা খাতুন বদলির আবেদন করেছিলেন ‘২নং শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ শূন্য পদে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাকে ওই স্কুলে বদলি না করে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার ‘বনগাঁ চক-রহমত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ শিক্ষক মিতালী কিসকুকে শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ নিয়ে আসার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। মিতালী কিসকু ৩১ মার্চ স্কুলে যোগদান করেন।

বদলগাছী উপজেলার ভুক্তভোগী সহকারী শিক্ষক আবদুল মতিন বলেন, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিত্বে বদলি করার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বার বার তাগাদা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমার কাছে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন।

বিলাশবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আফতাব হোসেন বলেন, আমি রাজনীতি পরিবারের সন্তান এবং নিজেও রাজনীতি করি। নিয়নপুর স্কুলের জায়গা দখল করে স্থানীয় কয়েকজন যুবক দোকান করার প্রতিবাদে শিক্ষা অফিসে একটা দরখাস্ত দেই। সে কারণে উপজেলা শিক্ষা অফিসার আতাউর রহমান স্যার আমাকে অফিসে ডেকে রাজনীতি করতে নিষেধ করেন এবং উল্টো চাকরি খেয়ে নেয়া ও মামলা করার হুমকি দেন। এসব বিষয় নিয়ে স্যার বিভাগীয় অফিসে আমার নামে অভিযোগ দিয়েছে। এ কারণে আমাকে গত মাসের ২৩ মার্চ নিয়নপুর স্কুল থেকে বিলাশবাড়ী স্কুলে বাড়ি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু আমি বদলির জন্য কোনো আবেদন করিনি। অনেকে আবেদন করেও বদলি হতে পারছেন না।

গত রোববার ছিল বদলির শেষ দিন। জেলা শিক্ষা অফিসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষকদের ছিল উপচে পড়া ভিড়। তারা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সুপারিশ নিয়ে জেলা শিক্ষা অফিসে এসেছিলেন। অফিসের অফিস সহায়কের কাছে বদলির আবেদনপত্র জমা দিয়ে স্মারক নাম্বারের জন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে।

মান্দা উপজেলার এক শিক্ষিকার স্বামী গোলাম মোস্তফা বলেন, তার স্ত্রী খালেদা খানম উপজেলার ভারশোঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওই স্কুল থেকে কালীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলির জন্য কাগজপত্র নিয়ে জেলা শিক্ষা অফিসে এসেছিলাম। তার আবেদনপত্রে স্মারক নাম্বার বসানোর পর অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলাম পরিচিত হওয়ায় কিছু টাকা মিষ্টি খেতে দিয়েছেন। তবে অন্যদের কাছ থেকে ৪-৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকরা খুশি হয়ে মিষ্টি খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিয়েছেন। আমি কারো কাছ থেকে জোর করে টাকা নেইনি।

বদলগাছী উপজেলা শিক্ষা অফিসার আতাউর রহমান বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে শিক্ষকদের বদলি করা হয়েছে। ঘুষ দাবি করার বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি। নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, আমার কাজ শুধু আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করা। আমি সে দায়িত্ব পালন করে আবেদনপত্র ছেড়ে দিয়েছি। এছাড়া কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close