মোঃ মিজানুর রহমান

  ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষণ

দর্শন ও অর্জন

বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের দিন ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতি নিজস্ব জাতিসত্তার পরিচয়ে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায় বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে যুদ্ধের শুরু হয়েছিল, সেই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে বাংলাদেশ নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয় বিশ্ব দরবারে। এই বিজয় অর্জনের পেছনে রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ।

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। শুরু করেছিল নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয় সারা দেশ। কিন্তু নিরস্ত্র বাঙালি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস-নির্মম হত্যাযজ্ঞের সামনে মাথা নত না করে যার যা ছিল তাই নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। তড়িৎ সেই প্রতিরোধযুদ্ধ রূপ নেয় মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান বিজয়। বাঙালি জাতিকে একাত্তর সালে শুধু সশস্ত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়নি। যুদ্ধ করতে হয়েছে পাকিস্তানিদের দোসর এ দেশীয় আলবদর, আলশামস, রাজাকারের বিরুদ্ধে। বাঙালি রুখে দাঁড়াতে সময় নেয়নি। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বীর বাঙালি। অনভ্যস্ত হাতেই তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। সম্মুখসমরে জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। পঁচিশে মার্চ ভয়াল রাতে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞ আর নৃশংসতার দীর্ঘ ৯টি মাসে রক্তস্নাত পথ পাড়ি দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ নির্যাতিতা মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল অমূল্য এই স্বাধীনতা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল বীর বাঙালি। ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রস্তুত হয়েছিল মঞ্চ। পার্শ্ববর্তী ঢাকা ক্লাব থেকে তাৎক্ষণিকভাবে আনা হয়েছিল একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার। পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জোন-বি এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে ৯১ হাজার ৫৪৯ জন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ভারতীয় বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী দালিলিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই দিন থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অনেক রক্ত, অনেক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এই দিনটি বাঙালি জাতির গৌরবের দিন, আনন্দের দিন, অহঙ্কারের দিন, আত্মমর্যাদার দিন। হাজার বছরের বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল বাঙালি জাতির নিজস্ব একটি আবাসভূমি।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল অন্ধকারের শক্তি ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন; গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সবাই মিলে এই বিজয়লাভের পেছনে ছিল মূলত বাঙালির জাতীয় অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। স্বাধীনতার অর্থ ছিল মানুষের আত্মার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক মুক্তি অর্থাৎ আর্থিক উন্নতির পথ সুগম করা। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল একটি সুখী-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় যে বাংলাদেশ হবে স্বপ্নের সোনার বাংলা। এবারের বিজয় দিবসে আমাদের সে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার শপথ নিতে হবে।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে আমাদের সংবিধান। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে শাসনতন্ত্রে প্রতিফলনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানে অটল থাকা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছাড়া বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনও সম্ভব নয়।

লেখক : রাজনীতিক ও বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist