মোতাহার হোসেন

  ২৯ এপ্রিল, ২০২৪

মতামত

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ‘হিট স্ট্রোক’

বৈশাখের শুরুতেই তীব্র দাবদাহে ছটফট করছে মানুষ এবং প্রাণিকুল। দিন দিন সূর্যের আগুন ঝরানো উত্তাপে পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ‘হিট স্টোকে’ রূপ নিচ্ছে। এ অবস্থা বিরাজ করবে মে মাস পর্যন্ত। গরম থেকে স্বস্তি পেতে মানুষ, পশু ও প্রাণিকুল ছুটছে ছায়া, কিছুটা ঠাণ্ডা বাতাসের খোঁজে। টানা প্রায় দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ইট, বালু, সিমেন্টে নির্মিত প্রাচীরঘেরা রাজধানীর এই চিত্র ক্রমেই গ্রাস করছে দেশের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ জেলাসহ দেশের অন্যত্র।

আবহাওয়া অফিস সূত্র বলছে, রংপুর, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি অতিক্রম করেছে। চলমান মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ পরবর্তী কয়েক দিন অব্যাহত থাকতে পারে এবং তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে বাড়তে পারে অস্বস্তিও। গত কয়েক দিনে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এমনি অবস্থায় আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশব্যাপী ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে এবং বিনা প্রয়োজনে মানুষকে ঘর থেকে বের না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। আর জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে হলে ছাতা ও পানি নিয়ে বের হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব এবং বাতাসে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ুমণ্ডল, উত্তপ্ত হচ্ছে ভূপৃষ্ঠও। এ কারণে দেশব্যাপী ‘হিট স্টোক’ পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে মনে করেন পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশে সবুজ বলয় ও মুক্ত জলাশয় কমে যাওয়ায় পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তদুপরি তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে যানবাহন, বাসা, অফিস, আদালত, ব্যাংকপাড়া, শিল্প-কারখানায় এসির অতিরিক্ত ব্যবহারে ‘উত্তপ্ত উনুনে ঘি ঢেলে’ দেওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

আবহাওয়াবিদদের ভাষ্য হচ্ছে দেশব্যাপী এই তাপপ্রবাহের মধ্যেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যে ঝড়, বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থাকবে স্বল্প সময়ের জন্য। এই পরিস্থিতি বিরাজ করবে মধ্য জুন পর্যন্ত। রাজধানীতে যে তাপমাত্রা, তা ছিল চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে কয়েক দিন ধরে টানা তাপপ্রবাহের মধ্যে বৈশাখের তৃতীয় দিন এক পশলা বৃষ্টিতে খানিকটা স্বস্তি এনেছে নগর জীবনে। তবে এই স্বস্তি সাময়িক। পরে ফের গরমের অস্বস্তিতে মানুষ। তীব্র গরমে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। বাইরে কড়া রোদ থেকে বাঁচতে অনেকে গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছে। কেউ আবার লেবুর শরবত খেয়ে স্বস্তির সন্ধান করছে।

এমনি অবস্থায় বিরূপ জলবায়ু মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি সময়ের দাবি এবং জনপ্রত্যাশা হলেও এ জন্য অধিক মাত্রায় মুক্ত জলাশয়, গাছপালা ও বন সৃজন, এসির ব্যবহার কমিয়ে আনা, নদ-নদীকে স্বাভাবিক অবস্থানে রাখা নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রকৃতির নিজস্ব রীতিনীতি আছে। প্রকৃতির ওপর মানুষের নিষ্ঠুর থাবা, বন ধ্বংস, পাহাড় কর্তন, মুক্ত জলাশয় ধ্বংস অব্যাহত থাকায় প্রকৃতির এমন প্রতিশোধ নেয় প্রায়ই। এর মধ্যে পাহাড়ধস, ভূমিধস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সময়ের বিবর্তনে পৃথিবী বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে উপনীত। প্রায় সাড়ে চার শ কোটি বছরের পুরোনো পৃথিবীতে মানুষের বসবাস মাত্র আড়াই লাখ বছর। তারপর মানুষ বুদ্ধির জোরে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এই গ্রহে বসবাসের উপযোগী করে তুলেছে। পাশাপাশি মানুষ যখন থেকে ভোগবিলাস-আরামণ্ডআয়েশের প্রতি ঝুঁকছে, ঠিক তখন থেকে ধীরে ধীরে শিল্প যুগের সূচনা হয়। একই সঙ্গে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

অবশ্য মানুষ যতটা প্রযুক্তিনির্ভর, শিল্পনির্ভর, অধিকমাত্রায় ভোগবাদী, অধিকমাত্রায় বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে, ততটাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় প্রকৃতিও বিরূপ আচরণ শুরু করেছে। বিশেষ করে ২০২১ সালের প্রারম্ভ থেকে সমগ্র বিশ্বের আবহাওয়া হয়ে উঠেছে টালমাটাল। এ মুহূর্তে বিশ্বের বহু দেশের মানুষকে ভয়ংকর দাবদাহে পুড়তে হচ্ছে, আবার বিশ্বের কোথাও কোথাও আবার ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অতিরিক্ত বন্যা ও ভারী তুষারপাত, অতিরিক্ত দাবানলে পুড়ছে। বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার এমন বৈরী আচরণ মূলত বেশির ভাগই মনুষ্যসৃষ্ট। ২০২৩ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বাধিক উষ্ণতম বছর। চলতি বছরের উষ্ণতা গত বছরকেও ছাড়িয়ে যাবে- এমন আশঙ্কা আবহাওয়াবিদদের।

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ইতিমধ্যে থার্মোমিটারের পারদ উঠেছে সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। প্রচণ্ড দাবদাহে সমগ্র দেশের জনজীবন অতিষ্ঠ। এসব হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল। শিল্পায়নের শুরু হতে মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড ও মিথেনের ভারসাম্য নষ্ট করছে, উত্তপ্ত করছে বায়ুমণ্ডলকে। কার্বন-ডাইঅক্সাইড ও মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সূর্যের উত্তাপকে বাধাগ্রস্ত করে। সেই উত্তাপ আবার বিশ্বের সব জায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে না, পরিণামে আবহাওয়ার এমন অস্বাভাবিক ও রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে। সময়ে-অসময়ে দেখা যাচ্ছে বন্যা, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি।

বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশেও বেশ কয়েকবার আঘাত হেনেছে। আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা আগামী বছরগুলোতে সমগ্র বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মারাত্মক রূপ ধারণ করবে। এ মুহূর্তে অতিরিক্ত দাবদাহে দেশের মানুষ আক্রান্ত। ঝড়ের সময় তাপমাত্রা কিছুটা কমে এলেও অন্যান্য ভোগান্তি বাড়ে বহু গুণে। কালবৈশাখী কিংবা অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যার সময় রাজধানীসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যায়। এ মুহূর্তে আমাদের ওপর এই বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব কমিয়ে আনাটাই শুধু চ্যালেঞ্জ। এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষকে কীভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায় তার পদ্ধতি রপ্ত করতে হবে। পাশাপাশি ক্রমেই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ, মুক্ত জলাশয় সৃষ্টি করে তপ্ত পৃথিবীকে বাঁচিয়া রাখা ও মানুষের স্বস্তির উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

অন্যদিকে বিশ্ববাসীর জন্য আরেকটি আশঙ্কার কথা হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ এবং এই শতকের শুরু থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের হিমবাহগুলো ক্রমবর্ধমান হারে গলতে শুরু করে। বিশেষত, গত দশকের মাঝামাঝি থেকে এই গতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিমশীতল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ এবং হিমালয়ের বরফ গলা অব্যাহত থাকায় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বিশ্বের জন্যই বড় ধরনের হুমকি। দক্ষিণ মেরুর বরফঢাকা পূর্বাঞ্চলের মালভূমিতে অবস্থিত কনকর্ডিয়া গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০২২ সালের ১৮ মার্চ এই অঞ্চলের তাপমাত্রা মৌসুমি গড় তাপমাত্রার চেয়ে ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা ‘বিশ্বের সবচেয়ে হিমশীতল জায়গার তাপমাত্রায় এমন পরিবর্তন যথেষ্ট উদ্বেগের বলেছেন।’ অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলতে থাকায় চারপাশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। অ্যান্টার্কটিকার এই পরিবর্তন গোটা মানবসভ্যতার জন্য মহাবিপদ ডেকে আনছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের জনজীবন বিপদাপন্ন হয়ে উঠছে। প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে অনেক দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হচ্ছে। দীর্ঘ খরার অভিঘাতে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সংকট দেখা দিচ্ছে। এমনি অবস্থায় প্রকৃতি, পরিবেশ সংরক্ষণ, অধিক হারে বনায়ন, বৃক্ষাচ্ছাদন, মুক্ত জলাশয়, জলাধার গড়ে তোলা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা হলে প্রকৃতির এই বৈরী আচরণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। এ নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করা দরকার।

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close