অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

  ২৯ এপ্রিল, ২০২৪

তথ্যের গড়মিলে নিরীক্ষকের আপত্তি

অনিশ্চয়তার পথে ঋণ জর্জরিত ঢাকা ডাইং

ছবি : সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক হিসাবমান (আইএএস) অনুসারে স্থায়ী সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন না করে এবং আর্থিক প্রতিবেদন ও ভ্যাট রিটার্নে দুই ধরণের তথ্য নিয়ে অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি শ্রম আইন অনুসারে কর্মচারীদের জন্য মুনাফায় শ্রমিক অংশগ্রহন তহবিলে (ডব্লিউপিপিএফ) অর্থ প্রদান করেনি। এর বাইরে কোম্পানির রিটেইন্ড আর্নিংস নেগেটিভ থাকা এবং সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহারে ব্যর্থতাসহ মতো বেশ কিছু বিষয়ে সমস্যায় জড়িয়ে কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে নিরীক্ষক কাজী জহির খান অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। এ নিয়ে নিরীক্ষক তার প্রতিবেদন দিলে বিষয়টি জানা যায়।

নিরীক্ষকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে বস্ত্র খাতের তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ৮৩ কোটি ৯ লাখ টাকা এবং স্বল্পমেয়াদে ৪২ কোটি ১১ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছে। দীর্ঘ ১০ বছরেরও অধিক সময়ে এই ঋণের সুদ ৩৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা সহ মোট পরিশোধযোগ্য অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫৮ কোটি ৮২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। ২০১৪ সাল থেকে এই ঋণের টাকা সমন্বয় না করায় কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো ব্লক করে দেয় ওইসব ব্যাংক।

কোম্পানিটি বিভিন্ন হিসাব বছরের জন্য ডব্লিউপিপিএফ বাবদ ৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকার প্রভিশন দেখিয়ে আসছে। শ্রম আইন ২০০৬ এর ২৩৪ ধারা অনুসারে এই তহবিলের অর্থ ৮০:১০:১০ অনুপাতে শ্রমিক অংশগ্রহন, কল্যাণ তহবিল এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে বন্টন করতে হয়। কিন্তু এ বিষয়ে ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের পরও প্রতিষ্ঠানটি অদ্যবধি শ্রমিকদের বা সংশ্লিষ্ট তহবিলে কোন অর্থই প্রদান করেনি।

নিরীক্ষক আরো জানায়, কোম্পানিটি সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে সম্পদ, কারখানা ও সরঞ্জামের মূল্য হিসেবে ৫১৬ কোটি ১১ লাখ টাকা দেখিয়েছে। তবে স্থায়ী সম্পদের কোন সঠিক তালিকা মেইনটেইন না করায় এর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি নিরীক্ষক। এমনকি ২০১০ সালে পর দীর্ঘ ১৩ বছরেও প্রতিষ্ঠানটি আইএএস-৩৬ অনুসারে ভূমি ছাড়া অন্য কোন স্থায়ী সম্পদের পুর্নমূল্যায়নও করেনি।

এদিকে উৎসে আয়করের ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং অগ্রিম আয় করের ২৯ লাখ টাকা নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করে দীর্ঘদিন যাবত ঝুলিয়ে রেখেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। এছাড়া চলতি দায় হিসেবে মূল্য সংযোজন করে (ভ্যাট) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ লাখ টাকা। কিন্তু সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন তৈরীর সময়ে কোম্পানিটি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ এবং ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১৬ অনুসারে এ অর্থের বিপরীতে নেগেটিভ ব্যালেন্স হিসাব করেনি।

এর বাইরে আর্থিক প্রতিবেদন ও ভ্যাট রিটার্নে দুই ধরনের তথ্য দেখিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে ঢাকা ডাইং কর্তৃপক্ষ। আর্থিক প্রতিবেদনে বিক্রি বাবদ আয় ও ক্রয় দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ৫২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং ২১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। কিন্তু ভ্যাট রিটার্নে আয় ৪ লাখ টাকা দেখালেও ক্রয় বাবদ কোন অর্থ দেখানো হয়নি। ফলে কোম্পানি ভ্যাট রিটার্নে আয় ৫২ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং ক্রয় ২১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা কম দেখিয়েছে। সর্বমোট ৭৪ কোটি ৮ লাখ টাকা ভ্যাট রিটার্নে কম দেখিয়ে কোম্পানিটি প্রতারণা করেছে। এ ধরনের তথ্যের হেরফের ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ এবং ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১৬ এর লঙ্ঘন।

আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানির ব্যবসা ও অন্যান্য বাবদ পাওনা রয়েছে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর সন্দেহজনক ঋণের জন্য সঞ্চিতি রাখার প্রয়োজন রয়েছে ১৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যদিও কোম্পানিটি পাওনার বিপরীতে ২১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং সন্দেহভাজর ঋণের বিপরীতে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা সঞ্চিতি রেখেছে। তবে নিরীক্ষিক বলছে, এ সঞ্চিতি নিয়ম মেনে যথাযথ রাখা হয়নি।

এর বাইরে রিটেইন্ড আর্নিংস নেগেটিভ হওয়া, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণের বোঝা এবং সক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করতে না পারাকে কোম্পানির দুর্বলতা হিসেবে নিরীক্ষক তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। একইসঙ্গে কোম্পানি তার ব্যবসায়ীক কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যেতে পারবে কিনা তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছে।

২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ঢাকা ডায়িংয়ের অনুমোদিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকা। যার বিপরীতে বর্তমানে পরিশোধিত মূলধন রয়েছে ৮৭ কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ৮ কোটি ৭১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫৩টি। এর মধ্যে ৫১ দশমিক ৭১ শতাংশই রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। অথাৎ কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্থ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবেন সাধারণ বিনিয়োগকারী। কোম্পানির বাকি শেয়ারের মধ্যে ৩০ দশমিক ১০ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে, ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং শূণ্য দশমিক ৩৭ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।

সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ হিসাব বছরে লোকসানের জন্য কোম্পানিটি বিনয়োগকারীদের কোন লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৫৮ পয়সা। যেখানে আগের হিসাব বছরেও শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছিল ১৪ পয়সা। ওই হিসাব বছরে অবশ্য নামমাত্র শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ পেয়েছেন বিনিয়োগকারী। এর আগে ২০২০ হিসাব বছরেরে জন্য ২ শতাংশ নগদ এবং তার আগের বছরে ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি।

কোম্পানির শেয়ারদর বর্তমানে ফেইসভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে সমাপনী দর দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৭০ পয়সা। গত এক বছরে শেয়ারটির দর ৮ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ১৮ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে ওঠানামা করেছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঢাকা ডাইং
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close