মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

বিশ্লেষণ

পরিবেশ সংকট : উত্তরণের উপায়

পরিবেশ সংকট বর্তমানে আলোচিত বিষয়। সারা পৃথিবীতে পরিবেশসংকট নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। প্রচেষ্টা জোরদার হচ্ছে পরিবেশসংকট দূর করার জন্য। পরিবেশসংকট নিছক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহারজনিত ফসল নয়। পরিবেশসংকটের ক্ষেত্রে ধর্ম বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও জীবন দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় রোধকল্পে দুটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। প্রথমত, প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং মানব জীবনের সব ক্ষেত্রে তার ঘনিষ্ঠ বিষয়ে ইসলামের ধারণা প্রচার। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক বিষয়ে ইসলামি শিক্ষার মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের আলোকে নৈতিক আচরণ এবং এর বাস্তব প্রয়োগ। মানুষের জীবনপ্রবাহ বিকাশের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সম্মিলিত অবস্থা ও পারস্পরিক সম্পর্ককে পরিবেশ বলে। পরিবেশের সব উপাদানের মধ্যে একটা গভীর আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান, যা পরস্পরকে প্রভাবিত করে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশের উপাদানকে বাহ্যিক জৈবিক ও সামাজিক উপাদান হিসেবে ভাগ করা হয়। বায়ু, আলো, পানি ও মাটি বাহ্যিক। মানুষ, বৃক্ষ, জীবজন্তু, জৈবিক এবং জনসংখ্যা সামাজিক উপাদানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশের সব উপাদান একটি অন্যের সম্পূরক হিসেবে বিবেচিত হয়।

পরিবেশের বাহ্যিক উপাদানগুলোর মধ্যে বায়ু, পানি ও আলো অন্যতম। রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তারা কি দেখে না যে, আমি রাত্রি সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্যে এবং দিনকে করেছি আলোকময়। নিশ্চয় এতে ইমানদার সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ - (সুরা নামল : ৮৬) কোরআনে বিশুদ্ধ বায়ু প্রবাহকে বৃষ্টির বার্তাবহ ও মন প্রফুল্ল হওয়ার নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি মসজিদ ও জনসমাজে সুগন্ধি ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করেছেন।

অন্য উপাদান পানি। যে কটি নেয়ামত ছাড়া এ ভূমণ্ডল অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে পারে, সেগুলোর মধ্যে পানি অন্যতম মূল্যবান। আর আল্লাহ তার নেয়ামতগুলো অপচয় করা থেকে আমাদের নিষেধ করেছেন। অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমাদের দেশ এবং বর্তমান পৃথিবীর গবেষকরা সুপেয় পানির ক্রমবর্ধমান অভাব এবং দূষিত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কিত, অথচ এসবের মূলে রয়েছে দৈনন্দিন জীবনে পানি ব্যবহারে আমাদেরই অপচয় এবং উদাসীনতা। বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতে পানির জন্য এ হাহাকার তো আমাদেরই কর্মফল। পানি একদিকে যেমন জীবন রক্ষা করে, অন্যদিকে পানি জীবন ধ্বংস হওয়ার কারণ। পানিদূষণের মাধ্যমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। পানিতে ব্যাকটেরিয়া, ধাতবজাতীয় পদার্থ, কীটনাশক ইত্যাদি মিশ্রিত হয়ে পানি দূষিত হয়। দূষিত পানির কারণে কিছু পানিবাহিত রোগ দেখা দিচ্ছে। অতএব, আমাদের উচিত পানিকে দূষণমুক্ত রাখা এবং পানির অপচয় রোধ করা। পানির পাশাপাশি আরো যত প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, সবকিছুর যথাযথ ব্যবহার, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করে আমরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করলে মানবসভ্যতায় নেমে আসবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ মর্মে রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে-জলে ও স্থলে বিপর্যয় ঘটেছে।’ - (সুরা রুম : ৪১) পবিত্রতা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ছাড়া সুন্দর পরিবেশ কল্পনা করা যায় না। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্রকে পছন্দ করেন; আল্লাহ পরিচ্ছন্ন, তিনি পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন; আল্লাহ মহৎ, তিনি মহত্ত্ব পছন্দ করেন; আল্লাহ বদান্য, তিনি বদান্যতা পছন্দ করেন। অতএব তোমরা তোমাদের (ঘরের) উঠোনগুলো পরিচ্ছন্ন রাখো।’ (তিরমিজি : ২৭৯৯) প্রিয়নবী (সা.) আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা পবিত্র, তিনি পবিত্রতাকে ভালোবাসেন।’ এ ছাড়া কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরও ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা : ২২২)

পরিবেশের সঙ্গে মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সেই ক্ষেত্রে এই দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ আল্লাহকে খুশি করার জন্য যাবতীয় কার্যাদি পরিচালিত করবে। উপার্জনও করবে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে। তাই প্রকৃতি বা বিশ্বময় বিদ্যমান সব সম্পদ মানুষের অধীনে করা হয়েছে। এ সম্পর্কে রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমরা কি দেখো না কীভাবে পৃথিবীর সবকিছু আল্লাহ তোমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছেন।’ (সুরা হজ : ৬৫) এই প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ইসলামের দৃষ্টিতে সীমিত পর্যায়ে মানুষকে পরিবেশের ওপর হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের প্রতি শুধু দায়িত্ব পালন করলে চলবে না, বায়ু, পানি ও পরিবেশদূষণ থেকে বিরত থাকতে এবং গাছপালা, জীব-জন্তুর প্রতিও সদয় ব্যবহার করতে হবে।

পরিবেশ আমাদের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আমাদের বেঁচে থাকার সব উপাদান আমরা পরিবেশ থেকে পাই। একই প্রাকৃতিক পরিবেশে যেসব জীব জন্মায় তাদের প্রত্যেকেরই স্বাতন্ত্র্য থাকে। এ রকম বিভিন্ন জীবের সংখ্যা সমষ্টিকে জীব-সম্প্রদায় বলা হয়। একেক অঞ্চলের জলবায়ু সে অঞ্চলের উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করে এবং প্রাণীরাও সেখানকার উদ্ভিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এভাবে একেক অঞ্চলের জড় পরিবেশ ও জীব-সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বেঁচে থাকার জন্য এরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সবকিছু নিজ অনুগ্রহে। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন। (সুরা জাসিয়া : ১৩)

একটি নির্মল ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য রক্ষায় গাছপালার গুরুত্ব সর্বাধিক। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা হলো, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষাপোকরণ ও চিকিৎসার সব কটি সরবরাহ হয়ে থাকে বৃক্ষকুল থেকে। গাছ সমগ্র প্রাণিকুলের জীবন রক্ষাদানে উপাদান অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, এরপর আমি এর দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি, আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙুরের বাগান, জয়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত এবং সাদৃশ্যহীন। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ করো যখন সেগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্বতার প্রতি লক্ষ করো। নিশ্চয় এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে ইমানদারদের জন্য।’ (সুরা আনআম : ৯৯)

মহান রাব্বুল আলামিন মানুষের কল্যাণের জন্যই যাবতীয় পশু-পাখি সৃষ্টি করেছেন। আমরা এগুলো থেকে দুধ, গোস্ত, চামড়া, পশম, মালামাল বহনের প্রয়োজনে, অর্থনৈতিক, চাষাবাদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উপকার পেয়ে থাকি। মহামহিম আল্লাহ বলেন, ‘গবাদি পশুর মধ্যে কতক ভারবাহী ও কতক ক্ষুদ্রকায় পশু সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তোমাদের যা রিজিকরূপে তোমাদের দিয়েছেন, তা হতে আহার করো। (সুরা আনআম : ১৪২) কতক পশুর পশম দ্বারা আমরা বস্ত্র ও শীতবস্ত্র তৈরি করে থাকি এবং হাড় ও দাঁত দ্বারা অনেক ব্যবহার্য জিনিস তৈরি করি। কোরআনের ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য তাতে শীত নিবারণ উপকরণ ও বহু উপকার রয়েছে এবং তা হতে তোমরা আহার করে থাকে।’ (সুরা নাহল : ৫)

আল্লাহ বা তার সৃষ্টির প্রতি অবিচার আর নির্যাতনের বিনিময়ে মানুষকে গৌরবান্বিত করার প্রবণতাকে ইসলাম সমর্থন করে না। পরিবেশের বিপর্যয় শুধু শিল্পোন্নত বা পাশ্চাত্যের সমস্যা নয়। তা সমগ্র পৃথিবীর জন্য এক মহাসমস্যা। গোটা পৃথিবীকে এ জন্য সচেতন হতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ইসলামের অনুসারীদের অধিক অধিকতর দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলামের শিক্ষা সবার সামনে উপস্থাপন করতে হবে। মানব গোত্রকে বুদ্ধিবৃত্তিতে ও নৈতিক শিক্ষায় উজ্জীবিত করতে হবে। তাহলেই আমরা পাব আদর্শ এক সমাজ, দূষণমুক্ত নগরী।

লেখক : প্রিন্সিপাল, শ্যামপুর কদমতলী রাজউক মাদরাসা

ঢাকা-১২০৪

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close