সোহেল রানা

  ১০ মে, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

আসুন গাছ লাগাই, উষ্ণতা কমাই

ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। দিন দিন তাপপ্রবাহ বাড়ছে বাংলাদেশেও। ছাড়িয়ে যাচ্ছে অতীতের সব রেকর্ড। গণমাধ্যমের খবরে আগে শুনেছি, মধপ্রাচের দেশগুলোয় ৪০ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রা ওঠে। এখন আমাদের দেশেই এই তাপমাত্রা বয়ে যাচ্ছে। তা থেকে বাঁচতে পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানোই মনে হয় উত্তম। এ ছাড়া আর কী বিকল্প হতে পারে! নিজের এলাকাকে সজীব রাখতে গাছ লাগানোই সর্বোৎকৃষ্ট কাজ। আসুন, গাছ লাগাই, গাছের যত্ন নিই। অন্যকে বৃক্ষরোপণ করতে উৎসাহিত করি। মূলত, গাছ লাগাতে হবে জাতির বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে।

তাপপ্রবাহে ঢাকা শহরের মানুষের জীবন নাভিশ্বাস। রাজধানীর সড়কগুলো দিয়ে হাঁটাই যাচ্ছে না। যশোরে সড়কের পিচ গলে গেছে। রাস্তার দুই ধারে গাছ থাকলে এমনটা হতো না নিশ্চয়ই। ঘর থেকে মানুষ বের হতে পারছে না চুয়াডাঙ্গায়। অনেক জায়গায় হিটস্ট্রোক করে মারাও যাচ্ছে মানুষ। তাপপ্রবাহে জনজীবন অতিষ্ঠ মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, দিনাজপুর ও রংপুরে। ভালো নেই নরসিংদীর মানুষও। গরমে মরে গেছে বাগেরহাটের পুকুরের মাছও। সারা দেশের চিত্র একই। অচিরেই কোনো উদ্যোগ না নিলে এর ভয়াবহতা আরো বাড়বে। আরো দুঃসহ হয়ে উঠবে জনজীবন।

একবার কল্পনা করুন তো, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি উদ্যান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, নরসিংদী সরকারি কলেজে অনার্স ভবনের পেছনের রাস্তার কথাটি। এ স্থানগুলো যেন সবুজের গালিচা। খারাপ মনটাও আপনা আপনি ভালো হয়ে যাবে এই জায়গাগুলো দিয়ে হাঁটলে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। মন থাকবে প্রশান্ত। যেখানে গাছ থাকবে, সেখানের তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবে চার ডিগ্রি কম থাকে।

আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় গাছ লাগানোর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। বালু মাটিতেই বিশেষ পদ্ধতিতে গাছ লাগানোর জন্য নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করেছে দুবাই। মরুভূমির দেশগুলোয় এমনিতেই তাপমাত্রা বেশি থাকে। তারা চিন্তা করেছে, এখন থেকে যদি তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে না আসা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে অবস্থা আরো খারাপের দিকে ধাবিত হবে।

ঢাকা শহর ও বিভাগীয় মহানগরীতে যে উড়ালসড়ক হয়েছে বা হচ্ছে, ইচ্ছা করলে কম শিকড় ছাড়ে এমন গাছ সড়কের দুই পাশে রোপণের পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারত। নিলে সারা বিশ্বে মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে যেত। তাহলে আমাদের দেশে সম্ভব নয় কেন? আমরা তো ছাদবাগান করছি। সেখানে তো সব ধরনের গাছই জন্মে এবং ফলও দেয়। আমাদের দেশের মাটি উর্বর। যেকোনো উদ্যোগই সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমরা কেন যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছি না।

মনে হয়, আমরা সবাই বড় বড় বাড়ি বানাতে চাই। সেখানে এসি লাগিয়ে গরম থেকে বাঁচতে চাই। ভাই, সবার তো এসি লাগানোর সামর্থ্য নেই। এসিও তো উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। বাড়ি বানানোর প্ল্যানে যদি গাছ লাগানের জোরালো নির্দেশনা থাকত। তা যদি মনিটরিং করা হতো- তাহলে মন্দ হতো না। এসবের দেখভালের দায়িত্ব রাজউক ও সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভার হাতেই। প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নত হলে ভালো থাকবে নতুন প্রজন্ম। দেশের সব কটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ইচ্ছা করলে পারে শহরকে ছায়াময় করতে। এসি-ফ্যান দিয়ে গরম থেকে কদিন বাঁচা যাবে? এতে চাপ বাড়ছে বিদ্যুতের ওপর।

বইয়ে পড়েছি, একটি দেশের ভূমির ২৫ শতাংশ বৃক্ষ বা বন থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশে এই অনুপাতে বনভূমি আছে কি? গত বছর তাপপ্রবাহে ব্রাক্ষণবাড়িয়া এলাকায় রেললাইন বেঁকে গেছে। রেললাইন সচল রাখতে রেল মন্ত্রণালয় গাছ লাগানোর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি? এমন দৃশ্য চোখে পড়লে জানাবেন। তবে তীব্র গরমে রেল মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে সব আন্তঃনগর ট্রেন স্থানভেদে ৪০ কিমি গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চালকরাও নাকি সেই নির্দেশনা মেনেই ট্রেন চালাচ্ছেন।

একটু সময় গল্পে গল্পে কাটাই। আশা করি, ভালো লাগবে। হৃদয়কেও ছুঁয়ে যেতে পারে। সমাজে মানুষ অনেকভাবেই অবদান রাখতে পারে। আমার সামর্থ্য থাকার পরও কেন আমি কোনো ভূমিকা রাখছি না? মনে হবে, এখনই শুরু করা দরকার। মাইনুদ্দীন আমার বন্ধু, বড় ভাই। একই ক্যাম্পাসে পড়াশোনা। দেড় যুগেরও বেশি চেনাজানা। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। তিনি কাজটি নাও করতে পারতেন। তারপরও বেশ কয়েক বছর ধরে নিজ উদ্যোগে করে যাচ্ছেন। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে রোপণ করে যাচ্ছেন তালবীজ ও নারিকেলগাছ। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। কাজটি করছেন বিবেকের তাড়নায়। তাল পাকার মৌসুমে কাপাসিয়া-কালীগঞ্জের বিভিন্ন হাট থেকে পাকা তাল সংগ্রহ করেন তিনি। প্রক্রিয়াজাত করে তালের রসও প্রতিবেশীদের বিলিয়ে দেন।

এই কাজে সহযোগিতা করেন তার গ্রামের কয়েকজন যুবক। খুব নিভৃতে কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি। তা নিয়ে ফেসবুকেও কোনো স্ট্যাটাস দেননি। বাহবা পাওয়ার চেষ্টা করেননি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের উড়ালপথে (নরসিংদী জেলা হাসপাতালসংলগ্ন) যে গাছগুলো দেখেন, সব তাদের হাতে রোপিত। তিনি চিন্তা করেছেন উড়ালসড়কে গাড়ি চলাচলে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। প্রখর রোদে মহাসড়ক উত্তপ্ত হতে পারে। গাছ থাকলে তো কিছুটা হলেও প্রতিকার সম্ভব। তার ফলও এখন আমরা পাচ্ছি। উড়ালসড়কে উঠলেই হিম বাতাস শরীরে লাগে। সবুজে চোখে স্বস্তি আসে। রাতের সুনসান নীরবতায় শোনা যায়, পাখিদের কলরব।

কেন তালবীজ রোপণ করেন? তার সুন্দর একটা ব্যাখ্যাও দিলেন মাইনুদ্দীন। তালগাছ শতবষর্ষী। ফল-কাঠ দুটিই পাওয়া যায়। বজ্রপাতনিরোধী। রোপণের পর গরু-ছাগল খায় না। নিজ গুণেই বড় হয় গাছ। যত্নও খুব বেশি নিতে হয় না। বছরে একবার ছেঁটে দিলেই চলে। কথা হচ্ছে- বৃক্ষ পাখি-কীটপতঙ্গের আবাসস্থল। বাস্তুসংস্থানে ভারসাম্য রাখে। বৃক্ষ-পানি ছাড়া তো মানুষের জীবন হুমকিস্বরূপ। অতিমাত্রায় নগরায়ণ ডেকে আনছে পরিবেশের বিপদ। বড় কোম্পানিগুলো অট্টালিকা করছে, শিল্প-কারখানা বানাচ্ছে, পরিবেশ রক্ষায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা? এই দায় প্রকৌশলীরাও এড়াতে পারবেন কি?

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কী ভাবছেন প্রকৃতি নিয়ে? সভা-সমাবেশে গাছ লাগানো, গাছ রক্ষার ব্যাপারে কোনো কথা বলছেন কি? প্রতিবাদ করছেন কি গাছ নিধনের ব্যাপারে? কিংবা নিজ নিজ এলাকায় বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন কি? যদি ছাত্রদল, যুবদল, ছাত্রলীগ, যুবলীগ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিত, তাহলে দেশটাকে অচিরেই সবুজ বানিয়ে ফেলা যেত। তীব্র গরম থেকে বাঁচত এ দেশের মানুষ। দুঃখের বিষয়, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেই তিন হাজার গাছ কাটার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই গাছ রক্ষার ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি?

কোথায় গাছ লাগানো যেতে পারে? এই যেমন : সড়ক বিভাজক, রাস্তার দুই ধারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, মসজিদ-মন্দিরে, গোরস্তানে, পতিত জমিতে, সড়ক-মহাসড়কে, রেললাইনের দুই পাশে, নদী ও খালের ধারে।

ওইসব স্থানে কী ধরনের গাছ লাগাব? একটু তথ্য জেনে নিই। রাস্তার ধারে : নিম, জারুল, কদম, সোনালু ও কৃষ্ণচূড়া। রাস্তার বিভাজক : জবা, রতনগাছ ও হিজল। উদ্যান : বটগাছ, কদম, চাপালিশ, কনকচাঁপা ও অশোক। পায়ে হাঁটার পথ : পারুল, চেরি, ঝাউগাছ ও দেবদারু। খোলা জায়গা : মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল ও অর্জুনগাছ ও বহেড়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : আম, কাঁঠাল, জাম্বুল, বেল, হরীতকী ও আমলকী। বাড়ির আঙিনা : আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, নারিকেল, কলাগাছ, জাম্বুরা, কামরাঙা ও বেল।

গাছ রোপণে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে ফলজ ও ঔষধি গাছকে। তাতে ঘাটতি মিটবে পুষ্টি চাহিদার। ফলে বেড়ে উঠবে আগামীর বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম।

লেখক : সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close