মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ১০ মে, ২০২৪

মতামত

শব্দদূষণ রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই

রাজধানী ঢাকার মতো এমন শব্দদূষণে আক্রান্ত রাজধানী শহর পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। এখানে শব্দের সহনশীল মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ তীব্র শব্দ প্রতিনিয়ত ঢাকাবাসীর কর্ণকুহরে এসে আঘাত হানছে। প্রতি বছর থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপনের রাতে আতশবাজির শব্দে মানুষের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। একবার তো আতশবাজির আগুনে মানুষ দগ্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরে তা থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় মধ্যরাত থেকে ভারী সব ট্রাক, মালপত্র বহনকারী লোডার তীব্র বেগে ছুটে চলতে শুরু করে। তখন রাস্তায় যানবাহনের ভিড় কম থাকলেও চালকরা অহেতুক সারা রাত বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে চলে। ফলে মাঝ রাতে মানুষের ঘুম ভেঙে যায়, হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠে। শব্দদূষণ এভাবে অজান্তেই ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে মানুষের শ্রবণশক্তিসহ শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) ‘বার্ষিক ফ্রন্টিয়ার্স রিপোর্ট-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শব্দ দূষণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর নির্বাচিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমোদনযোগ্য শব্দ সীমার মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। এ ছাড়া বাণিজ্যিক এলাকা ও যেখানে যানজট রয়েছে সেখানে এই মাত্রা ৭০ ডেসিবেল। ঘনবসতিপূর্ণ ও ব্যাপক যানজটের শহর ঢাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১১৯ ডেসিবেল এবং এরপরই রয়েছে রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। পরিবেশগত শব্দের উৎস হিসেবে রাস্তার যানজট, বিমান চলাচল, রেল চলাচল, যন্ত্রপাতি, শিল্প ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের শব্দ শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে উল্লেখ করা হয়। অন্য এক গবেষণা মতে, ঢাকার অনেক জায়গায় শব্দমাত্রা ১০৭ ডেসিবল পর্যন্ত ওঠে যায়। অথচ ১০০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দেই একজন মানুষ চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। উপযুক্তভাবে উদ্দীপিত হলে যেকোনো স্থিতিস্থাপক কম্পমান বস্তু শব্দের উৎস হিসাবে কম্পিত হয়। শব্দের উৎস বস্তুর শব্দানুভূতির সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ কম্পাঙ্কই শ্রুতিসীমা, যা ২০ থেকে ২০ হাজার সিপিএস পর্যন্ত হতে পারে।

আইনানুসারে, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব জায়গায় গাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আটটি বিভাগে গাড়ির হর্নকেই প্রধান শব্দদূষণের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সুস্থ ও স্বাভাবিক শ্রবণক্রিয়ার তীব্রতা পরিবর্তনের মান শ্রুতিসীমার মধ্যে থাকা জরুরি। শব্দের উচ্চ শ্রুতিসীমার বেশি তীব্রতা স্বাভাবিক শ্রবণক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে। ফলে শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পেয়ে ধীরে ধীরে কানের শ্রুতি গ্রহণের ক্ষমতা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া শব্দের অতিরিক্ত তীব্রতা শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বজ্রপাতের শব্দের মতো দু-একটি ছাড়া শব্দদূষণের বেশির ভাগ কারণই মানুষসৃষ্ট। উচ্চৈঃস্বরে কথা বলার সময়ও শব্দ দূষণের সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকভাবে কথোপকথনের সময় সৃষ্টি হওয়া ৬০ ডেসিবেল শব্দে কোনো দূষণ হয় না। তবে এক জায়গায় বেশি সংখ্যক মানুষ একত্রিত হলে সবার ধীরস্বরে কথা বলাও দূষণের সৃষ্টি করে।

বাতাসের মাধ্যমে সহনক্ষমতার অধিক তীব্র বা তীক্ষè, বিশেষ করে সুরবর্জিত শব্দের উপস্থিতিতে মানুষ তথা জীব পরিবেশের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়, তাকেই শব্দদূষণ বলা হয়। অপরিণামদর্শী মানুষ তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত শব্দদূষণ ঘটিয়ে চলেছে। মানব-সত্যতার বিকাশমান ধারায় অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পের দ্রুত প্রভাব, পরিবহনের অবাধ প্রবাহ প্রতিনিয়ত সুরবর্জিত শব্দের বিস্তার ঘটাচ্ছে। ফলে শব্দদূষণও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে শব্দদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস পরিবহন। মাত্রাধিক ডিজেল ইঞ্জিনচালিত বাস, ট্রাক, কার, মোটরসাইকেল থেকে উত্থিত অনিয়ন্ত্রিত শব্দ পরিবেশ দূষণেরও অন্যতম কারণ। এসব যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চণ্ডতীব্রতাসম্পন্ন হাইড্রোলিক বা বৈদ্যুতিক হর্ন হচ্ছে শব্দদূষণের প্রধান উৎস। স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর স্থানেও এসব তীব্র শব্দের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি নেই। এ ছাড়া রেলস্টেশনের ট্রেনের হুইসেলের শব্দ ৯০ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বে, যা মানুষের শ্রবণক্ষমতার বাইরে। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক সময় জেনারেটর ব্যবহারের ফলে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। প্রচারের কাজে, সভায় বক্তৃতাকালে এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহারেও শব্দদূষণ হয়। বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি চালানোর শব্দ এলাকায় দূষণের সৃষ্টি করে। এ ধরনের শব্দের মাত্রা সাধারণত ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবেল হয়ে থাকে। শিল্প-কারখানার ব্যবহৃত সাইরেন থেকে ১৪০ ডেসিবল মাত্রার তীব্র শব্দ উত্থিত হয়। বিমানবন্দর এলাকায় বসবাসকারীদের কাছে বিমান উড্ডয়ন এবং অবতরণের সময় প্রায় ১১০ ডেসিবেলের শব্দদূষণ হয়ে থাকে। উচ্চগতির জেট বিমান ও কনকর্ড বিমানের শব্দদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

শব্দের উৎসের কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষই শব্দদূষণ দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়। সুরবর্জিত উচ্চ তীব্রতাসম্পন্ন শব্দ মানবদেহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। শব্দদূষণের প্রত্যক্ষ প্রভাবে মানুষের শ্রবণশক্তির ওপর অস্থায়ী বা স্থায়ী যেকোনো ধরনের ক্ষতি হতে পারে, যা কালক্রমে শ্রবণশক্তিহীনতা থেকে বধিরত্বে রূপ নিতে পারে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়, সুরবর্জিত তীব্র শব্দ পরোক্ষভাবে মানুষের দেহে স্নায়ুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্নায়ুতন্ত্রের ওপর এ ধরনের সুরবর্জিত উচ্চমাত্রার শব্দের প্রভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া, রক্তচাপ, শ্বাসক্রিয়া, দৃষ্টিশক্তি এমনকি মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপে অস্থায়ী বা স্থায়ী প্রভাব ফেলে। উচ্চ মাত্রার শব্দদূষণে হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। স্নায়ুতন্ত্রের সক্রিয়তা বেড়ে দেহের চলাচলে গতি-প্রকৃতির ক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের ও মস্তিষ্কের কোষের ওপর অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। একাগ্রতা হ্রাস পেয়ে হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া এবং মাথা ধরার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কখনো উচ্চ মাত্রার সুরবর্জিত শব্দের কারণে কানের পর্দা ছিঁড়ে গিয়ে আংশিক বা পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি বাতাসে ছড়িয়ে পড়া সুরবর্জিত শব্দদূষণের কারণে অন্যান্য প্রয়োজনীয় শব্দ শুনতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। শব্দদূষণে মানবদেহের রক্তের শর্করার ওপর প্রভাব ফেলে। রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। এমনকি সুরবর্জিত উচ্চমাত্রার শব্দে মানসিক অবসাদ সৃষ্টি ও স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে।

বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কী ধরনের শব্দদূষণ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। শব্দদূষণের জন্য দোষী হিসেবে কেউ প্রমাণিত হলে প্রথম অপরাধের জন্য এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুই ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার কথা বলা রয়েছে। বিধান রয়েছে, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ এবং ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের চারপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন শহরকে নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা- এই ৫ ভাগে ভাগ করে এলাকার দিন ও রাত ভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে বলা আছে, সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজে ব্যবহারের কোনো যন্ত্র চালানো যাবে না। ভয়াবহ শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে ২০১৭ সালে রিট করা হলে হাইকোর্ট রাজধানীতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। এই আদেশে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানিও নিষিদ্ধ করা হয়। এ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি। আকাশপথে চলাচলকারী বাহনে কম শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী ইঞ্জিন এরই মধ্যে বের হয়েছে। উৎসব, আয়োজনে মাইক বা লাউড স্পিকার বাজানোর জন্য শব্দসীমা নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যক। বর্ষবরণের মতো উৎসব আয়োজনে আতশবাজির মতো উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী সব ধরনের আয়োজন বন্ধ করা জরুরি। বাড়িঘরে, স্কুল-কলেজে, হাট-বাজারের মতো জায়গায় নিচু স্বরে কথা বলার অভ্যাস করা দরকার। জনসচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং ব্যক্তিগত গাড়িচালক, বাসচালক, ট্রাকচালকদের সচেতনতা বৃদ্ধিও এ ধরনের শব্দদূষণ কমাতে সহায়ক হতে পারে। আইন মেনে না চললে বিধান অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে আগামীতে পরিস্থিতি হবে আরো ভয়াবহ এবং এর নির্মম শিকার হবে আমাদের নতুন প্রজন্ম। শব্দদূষণ রোধে সমষ্টিগত উদ্যোগের বিকল্প নেই।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close