সংগীত কুমার

  ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

তাপপ্রবাহে হিট স্ট্রোক : ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েই চলছে। ফলে কিছুদিন ধরে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। দাবদাহে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। গত ২০ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই দুই জেলায় কিছু দিন ধরেই তাপমাত্রা বেশি। ‘অতিরিক্ত তাপমাত্রা, বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকা এবং বায়ুপ্রবাহ কম থাকায় অতি উষ্ণ আবহাওয়া তৈরি হচ্ছে’। ঘর থেকে বের হলেই যেন মরুভূমি লু হাওয়া। প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে আর্দ্রতা জ্বালা ধরাচ্ছে শরীরে। দরদর করে ঝরছে ঘাম। এ সময়ে মাঝেমধ্যে কালবৈশাখী ও বৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি আনে; কিন্তু এবার তা-ও নেই। গত দুই বছরের মধ্যে এবারও এপ্রিল মাস যেন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। একসময় রাজশাহী বিভাগ ও খুলনা বিভাগের একাংশে প্রচণ্ড গরম পড়ত। আর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে গরমের কষ্ট ছিল বেশি। গত ১০ বছরে দেশের ৮০ শতাংশ এলাকা জুড়ে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত থেমে থেমে তাপপ্রবাহ বইছে। আর সবচেয়ে বেশি কষ্ট ও ভোগান্তি তৈরি করেছে এ মাসের বেশির ভাগ সময় জুড়ে বয়ে যাওয়া অতি উষ্ণ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, যা ‘ওয়েট বাল্ব গ্লোব টেম্পারেচার’ নামে পরিচিত। এ ধরনের উষ্ণ আবহাওয়া বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাণঘাতী দুর্যোগে রূপ নিতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড গরমে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা, আর গরমের উৎপাতে দিশাহারা মানুষ ও প্রাণিকুল। সবচেয়ে বেশি কষ্টে পাচ্ছে শিশু ও বয়ষ্করা। দেশের যেসব জেলায় এই দাবদাহ প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে, সেখানকার হাসপাতালগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। গরমের কারণে নানা রকম অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। তবে গত কয়েক দিনের তীব্র দাবদাহে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

হিট স্ট্রোক কী : গরমের সময় একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হলো হিট স্ট্রোক। হিট স্ট্রোক হলো এমন একটি মেডিকেল কন্ডিশন, যেখানে দীর্ঘ সময় রৌদ্রতাপের কারণে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক স্তর থেকে বেড়ে একটি মারাত্মক স্তর ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত পৌঁছে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের টিস্যুর স্বাভাবিক কার্যক্ষতাকে নষ্টের মাধ্যমে বিভিন্ন টিস্যুর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বাধাগ্রস্ত করে রোগীকে ক্লিনিক্যাল বা প্যাথলজিকাল অবস্থায় উপনীত করে। হিট স্ট্রোক কখনো কখনো শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে রোগীকে দীর্ঘ মেয়াদে অক্ষম করে তুলতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। প্রয়োজনে ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় ধরে কাজ করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যায় এবং হিট স্ট্রোক দেখা দেয়।

হিট স্ট্রোক কাদের বেশি হয়? প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যে কারো হিট স্ট্রোক হতে পারে। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন-

১. শিশু ও বৃদ্ধের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা যেহেতু প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার বা হার্টের রোগী, স্ট্রোক বা ক্যানসারজনিত রোগে যারা ভোগেন, এমনকি যেকোনো কারণে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন, তাদের ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিটা একটু বেশি।

২. দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে যারা কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি থাকে। যেমন : কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক ও ভ্যানচালক।

৩. শরীরে পানিস্বল্পতা দেখা দিলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

৪. কিছু কিছু ওষুধ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়; বিশেষ করে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ, বিষণ্ণতার ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ ইত্যাদি।

হিট স্ট্রোকের লক্ষণগুলো কী? তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রোকের আগে অপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক হিট ক্র্যাম্প অথবা হিট এক্সহসশন হতে পারে। হিট ক্র্যাম্পে শরীরের মাংশপেশি ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা পায়, এর পরের ধাপে হিট এক্সহসশনে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস মাথাব্যথা ও ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি দেখা যায়। এই দুই ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর অত্যন্ত ঘামতে থাকে। এ অবস্থার দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হিট স্ট্রোক হতে পারে। এর লক্ষণগুলো হলো :

১. শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়। ২. ঘাম বন্ধ হয়ে যায়। ৩. ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে যায়। ৪. নিঃশ্বাস দ্রুত হয়। ৫. নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়। ৬. রক্তচাপ দ্রুত কমে যায়। ৭. খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্নতা ইত্যাদি। ৮. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া। ৯. রোগী শকেও চলে যায়। এমনকি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

প্রতিরোধের উপায় কী? গরমের দিনে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। সেগুলো হলো :

১. হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করুন। কাপড় সাদা বা হালকা রঙের হতে হবে। সুতি কাপড় হলে ভালো হয়।

২. যথাসম্ভব ঘরের ভেতর বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন। অতি প্রয়োজন না হলে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।

৩. বাইরে একান্ত যেতেই হলে মাথার জন্য চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করুন। বাইরে যারা কাজকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তারা ছাতা ব্যবহার করতে পারেন।

৪. পানি ও অন্যান্য তরল পান করুন। মনে রাখবেন, গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই বের হয়। তাই পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয় যেমন- খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদি পান করতে হবে। পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে।

৫. তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী পানীয় যেমন- চা কিংবা কফি যথাসাধ্য পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৬. রোদের সময় শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এসব কাজ যথাসম্ভব রাতে কিংবা খুব সকালে করার চেষ্টা করুন। যদি দিনেই করতে হয়, তবে কিছুক্ষণ পরপর রোদ থেকে সরে গিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে।

আক্রান্ত হলে কী করণীয়? প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রোকের আগে যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই যা করতে পারেন তা হলো :

১. দ্রুত শীতল কোনো স্থানে চলে যান, যদি সম্ভব হয় ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন।

২. ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করুন।

৩. প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। চা বা কফি পান থেকে বিরত থাকুন।

কিন্তু যদি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েই যায় তাহলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, ঘরে চিকিৎসা করার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে রোগীর আশপাশে যারা থাকবেন তাদের করণীয় হলো :

১. রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে নিয়ে যান। ২. রোগীর কাপড় খুলে দিন। ৩. শরীর পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে বাতাস করুন। এভাবে তাপমাত্রা কমাতে থাকুন। ৪. সম্ভব হলে কাঁধে, বগলে বা কুঁচকিতে বরফ দিন। ৫. দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। ৬. সব সময় খেয়াল রাখবেন হিট স্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস ও নাড়ি চলছে কি না! প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিঃশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। হিট স্ট্রোকে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে। এমনকি রোগী মারাও যেতে পারে। চলতি মাসের ৪ তারিখ মালয়েশিয়ায় হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিন বছরের একটি শিশু মারা যায় (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো)। তাই গরমের এই সময়টায় সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। দ্রুত সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসা নিলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

৭. এই তীব্র গরমে শিশুদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি। বাচ্চাদের বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে। তারপর খেয়াল রাখতে হবে রোদের মধ্যে যেন শিশুরা বেশিক্ষণ দৌড়ঝাঁপ না করে।

এই তীব্র গরমে সবাই এসব সতর্কতা অবলম্বন করলে, হিট স্ট্রোকের মৃত্যুঝুঁকি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব।

লেখক : শিক্ষার্থী, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close