সাজ্জাদুল করিম

  ০৯ মে, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

বই পড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ি

এই তো কয়েক দিন আগেই সারা দেশে উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হলো জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ২০২৪। সারা দেশের মানুষকে বই পড়া, জ্ঞানচর্চা ও গ্রন্থাগার ব্যবহারে উৎসাহিত করার মাধ্যমে একটি জ্ঞানমনস্ক আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ‘খ’ ক্যাটাগরির দিবস হিসেবে ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। যার প্রেক্ষাপট হলো- ১৯৫৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় সরকারি উদ্যোগে প্রথম কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল, যা বর্তমানে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর হিসেবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সাল থেকে সারা দেশে অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। সপ্তমবারের মতো উদযাপিত হওয়া এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘গ্রন্থাগারে বই পড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ি’। খুবই সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক প্রতিপাদ্য। যদিও প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, গ্রন্থাগারে বই পড়ার সঙ্গে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কি সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু বিষয়টি নিয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই এর তাৎপর্য বোঝা কঠিন হবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।

২.

তো চলুন প্রথমেই জানার চেষ্টা করি, স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে কী বোঝায়। স্মার্ট বাংলাদেশ এই ধারণাটি মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত একটি প্রতিশ্রুতি, যা ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম উচ্চারণ করেন। বাস্তবিক অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটির পরবর্তী ধাপই হলো স্মার্ট বাংলাদেশ। এই ধারণাটি ২০৪১ সালের মধ্যে ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হবে, যা সময়োপযোগী, বাস্তবসম্মত এবং যৌক্তিক পরিকল্পনা। স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে মূলত এমন বাংলাদেশকে বোঝায় যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদন এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা আরো সহজে জনগণের হাতের নাগালে পৌঁছে দেওয়া যাবে। বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন : AI, IOT, VR, Robotics, Nano Technology, 3D printing, Big data ইত্যাদির সর্বাধিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের জীবনকে সহজ করাই স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণার মূল কথা। এই ধারণাটি প্রধানত চারটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো : ১. স্মার্ট নাগরিক, ২. স্মার্ট সরকার, ৩. স্মার্ট অর্থনীতি ও ৪. স্মার্ট সমাজ।

৩.

এখন বই পড়ে কীভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া যায় বা লাইব্রেরি কীভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করবে, চলুন সে সম্পর্কে একটু আলাপ করি। প্রথমত, আমরা জেনেছি স্মার্ট বাংলাদেশের প্রথম যে ভিত্তি সেটি হলো স্মার্ট সিটিজেন। এখন প্রশ্ন হলো স্মার্ট সিটিজেন বলতে কী বোঝায় বা স্মার্ট সিটিজেন আসলে কারা। সহজ করে বললে ওইসব জনগোষ্ঠী বা নাগরিকদের স্মার্ট সিটিজেন বলা যায়, যারা জ্ঞানে-গুণে, চিন্তা-চেতনায়, বিশ্বাসে-দৃষ্টিভঙ্গিতে, আচার-আচরণে, কাজে-কর্মে, সর্বদা ইতিবাচক, প্রগতিশীল, কর্মদক্ষ, আধুনিক ও সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারেন। অর্থাৎ আমরা যে মনে করি- কোনো ব্যক্তির স্মার্টনেস শুধু তার পোশাকপরিচ্ছদ ও সাজসজ্জার ওপর নির্ভর করে, তা সঠিক নয়। কারণ স্মার্টনেস মূলত ব্যক্তির জ্ঞান-দক্ষতা, চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস-দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-আচরণ, কাজকর্ম, কথাবার্তা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এখন কথা হলো স্মার্ট সিটিজেন কীভাবে হওয়া যায়। এর সহজ উত্তর হচ্ছে- বই পড়া তথা জ্ঞানার্জন করা। বই পড়ার মাধ্যমে ব্যক্তির জ্ঞান ও দক্ষতা বিকশিত ও শানিত হয়, চিন্তা-চেতনার উৎকর্ষ হয়, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস ইতিবাচক ও উন্নত হয়, আচার-আচরণ মার্জিত হয়, কথাবার্তা ও কাজকর্ম পরিশীলিত ও পরিপাটি হয়, যা তাকে আদর্শ মানুষ তথা সুনাগরিক বা স্মার্ট নাগরিকে পরিণত করে।

দ্বিতীয়ত, ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থনীতিও হবে স্মার্ট। যার মূল অনুষঙ্গই হলো জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি (Knowledge Economy)। অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক পুঁজিই (বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, উদ্ধাবন, ফলিত গবেষণা ইত্যাদি) যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন ও ভোগের মূল কাঁচামাল হিসেবে বিবেচিত হবে। তা ছাড়া বর্তমান সরকার যে হাইটেক পার্ক, আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর তৈরি করছে সেখান থেকে বিভিন্ন আইটি পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিপণন ইত্যাদিও স্মার্ট অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। সেজন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী গবেষণা ও নিবিড় জ্ঞানচর্চা। আর এভাবেই বই পড়া তথা লেখাপড়া স্মার্ট অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে।

তৃতীয়ত, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আরো যে দুটি ক্ষেত্র রয়েছে তথা- স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ সেগুলো বাস্তবায়নের প্রথম ধাপই হলো বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করা। আর সেজন্য প্রয়োজন এই বিষয়গুলো নিয়ে সর্বাগ্রে চিন্তা করা, লেখাপড়া ও গবেষণা করা। এ প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক ইসমাইল হোসেন সিরাজী তার ‘আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বিশ্বাস হইতে চিন্তা ও চিন্তা হইতে কার্যের উৎপত্তি।’ অর্থাৎ যেকোনো কাজের শুরুই হয় চিন্তা থেকে, বিশ্বাস থেকে। উদাহরণ হিসেবে বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞানী জুলস ভার্নের কথা উল্লেখ করছি। আজ থেকে কয়েক শ বছর আগে রচিত হয়েছিল তার বিখ্যাত সাহিত্যকর্মগুলো (যেমন : Journey to the center of the earth (1865), Twenty thousand leagues under the sea (1870), Around the world in eighty days (1873) ইত্যাদি), যা আজও বিজ্ঞানীদের চিন্তার খোরাক জোগায়। অর্থাৎ যে চিন্তা-কল্পনাগুলো তিনি কয়েক শ বছর আগেই করেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। একইভাবে আমরা যদি স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই তার জন্য আমাদেরও প্রথমে চিন্তাভাবনা করতে হবে, বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পরিবর্তিত বিশ্বে আগামীর অর্থনীতি, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা কোন দিকে যাবে সে বিষয়ে জানার পরই না আমরা সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারব। যার জন্যও লেখাপড়া তথা গবেষণার বিকল্প নেই।

চতুর্থত, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের শুধু কথায় নয় কাজেও স্মার্ট হতে হবে। কুসুমকুমারী দাশের ভাষায় বললে, ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। অর্থাৎ শুধু মুখে মুখে জপ করলেই তো আর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়, তার জন্য কাজ করতে হবে। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে আইটি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনগোষ্ঠী নিয়োগ করতে হবে। সেজন্য আমাদের কর্মদক্ষ নাগরিক হিসেবেও গড়ে উঠতে হবে। বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতাগুলো যেমন : Creativity, Critical Thinking, Problem Solving, Innovation, Communication skill, Information Literacy, ICT Literacy ইত্যাদি রপ্ত করতে হবে। আর এই দক্ষতাগুলো রপ্ত করার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বই পড়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

পঞ্চমত, আমরা জানি একটি দেশ বা জাতির উন্নয়নে বড় বাধা হলো দুর্নীতি বা অনিয়ম। যে বিষয়টি বঙ্গবন্ধুও উপলব্ধি করতেন এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণগুলোতে তিনি এই কথাটি বারবার উল্লেখ করেছেন। দুর্নীতি বা অনিয়মই একটি জাতির জীবনে ক্যানসারস্বরূপ, যা সেই জাতিকে ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌঁছে দেয়। অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পারব- বিভিন্ন প্রাচীন ও বড় বড় সভ্যতা ধ্বংসের পেছনে একটি অন্যতম কারণ ছিল এই দুর্নীতি। আর এ থেকে উত্তরণে কার্যকর ও সর্বোত্তম উপায় হলো মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত ও শানিত করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র তথা পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, সমাজ, রাষ্ট্র- সর্বত্রই নীতিনৈতিকতার চর্চা করা। এ ক্ষেত্রে ভালো ভালো বই যেমন- ধর্মীয়, অনুপ্রেরণামূলক বই, মনীষীদের জীবনী, বিভিন্ন সভ্যতা ও জাতির ইতিহাস ইত্যাদি পাঠ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই- ভূখণ্ড, সরকার, সার্বভৌমত্ব, মানচিত্র যত যাই বলি না কেন; মানুষই একটি দেশের বা রাষ্ট্রের মূল সম্পদ। মানুষের জন্যই সবকিছু। মানুষ আছে বলেই বাকি শব্দগুলোর অস্তিত্ব আছে। এজন্য মানুষ ও মনুষ্যত্বের উন্নয়নের মাধ্যমে সুনাগরিক তথা স্মার্ট নাগরিক তৈরি করাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই তো স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য যে ভিত্তিগুলোর কথা বলা হয়েছে তার প্রথমটিই হলো স্মার্ট নাগরিক। আর এই স্মার্ট নাগরিকরাই গড়ে তুলবে স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সমাজ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও জেলা লাইব্রেরিয়ান শেরপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close