জি কে সাদিক

  ২৪ জুলাই, ২০১৭

নিবন্ধ

সৃজনশীলতা বিকাশের অন্তরায়

মানুষের জ্ঞান ক্রমবর্ধমান ও অনুসন্ধানী। শিক্ষা মানুষের আচার-আচরণ ও চিন্তাধারাকে পরিশীলিত করে। অনুসন্ধান বা নতুনত্বের আকাক্সক্ষা মানব সভ্যতাকে ক্রমে উৎকর্ষ অর্জনে প্রেরণা দিয়েছে। এক সময় গ্রামের মানুষ ছিল কৃষিনির্ভর। ক্রমশ কমে আসছে কৃষিনির্ভরতা। কৃষকের ছেলে পৈতৃক সম্পত্তিতে চাষ করবে-এটাই ছিল গ্রাম্য প্রথা। কিন্তু এখন এমন মানসিকতা আর নেই। গ্রামীণ জীবনে আসছে পরিবর্তন। এখন গ্রাম-শহর সর্বত্র চলছে শিক্ষা বিপ্লব। পেশা পরিবর্তনে ও উন্নত জীবনের সন্ধানের প্রতিযোগিতা চলছে। সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই শিক্ষা বিপ্লব শুরু হয়েছে।

‘মানুষের জ্ঞান ক্রমবর্ধমান ও নতুনত্ব সন্ধানী।’ আর শিক্ষার মাধ্যমেই জ্ঞানার্জন হয়। তাহলে আমাদের জ্ঞান কি বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমরা কি নতুন কিছু পাচ্ছি? কারণ মানুষের জ্ঞান ভা-ার সমৃদ্ধি লাভ করে শিক্ষালাভের মাধ্যমেই। জ্ঞান মানুষকে প্রতিনিয়ত নতুনত্বের সন্ধান দেয়। পুরাতনকে পরিবর্তনের শিক্ষা দেয়। জীর্ণতাকে

উপড়ে ফেলে নতুন করে গড়ার সাহস

ও প্রেরণা জোগায়। আমরা পাঠ করি,

কিন্তু তার মর্মার্থ অনুধাবনে সচেষ্ট নই। যতটা সচেষ্ট মর্মার্থ অনুধাবনে নই, তার চেয়ে অনেক কম সচেষ্ট তা বাস্তবায়নে। কবি সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতাটা পড়েছি ঠিকই, কিন্তু তার যথার্থ শিক্ষাটা যতটা বোঝার প্রয়োজন ততটা বুঝতে পারিনি। কবি তার কবিতাতে বিশ্বের যাবতীয় কিছুকে শিক্ষক ভেবেছেন আর নিজে হয়েছেন ছাত্র। কবি সূর্যকে, বায়ুকে, পাহাড়কে এমনিভাবে গোটা সৃষ্টি জগতকেই শিক্ষালয় হিসেবে গণ্য করেছেন। যা শিক্ষার বাস্তব উপকরণ। শিক্ষার অন্যতম একটা গুণ হলো যে, শিক্ষা হবে প্রয়োগধর্মী। শিক্ষা বাস্তবতার চাহিদার আলোকে হবে। আর আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জীবনের সর্বত্র শিক্ষার প্রয়োগ ঘটাবে। শিক্ষার আলোকে সে হবে সৃষ্টিশীল গুণের অধিকারী। যাকে আমরা বলি সৃজনশীলতা। শিক্ষাকে যদি আমরা সমাজ থেকে বাইরে নিয়ে যাই, তাহলে শিক্ষা তার লক্ষ্যচ্যুত হতে বাধ্য। কারণ মানুষ যে শিক্ষা গ্রহণ করে তার আলো

সমাজে বাস্তবায়ন না হলে সে সমাজ শিক্ষার ফল থেকে

বঞ্চিত হবে। অজ্ঞতার অন্ধকার ছেয়ে বসবে। একটা

অপ্রিয় সত্য কথা হলো, আমাদের শিক্ষা সমাজের সঙ্গে একতা পোষণ করে হচ্ছে না। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখছি এক রকম আর সমাজে অন্যভাবে তা প্রয়োগ করছি। কারণ যেখান থেকে শিক্ষার উপকরণ সংগৃহীত হয় আমরা সে স্থান থেকে দূরে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি সমাজ বদলানোর শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গতানুগতিকতা আমাদের সমাজকে অচল করে দেবে।

একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান শাখা থেকে পড়ালেখা শেষ করে তার মেধা অনুযায়ী ওই শাখায় কিছু করার মতো সুযোগ না পেয়ে যখন অন্য পথে জীবিকার অনে¦ষণে বের হয়, তখন তার অর্জিত জ্ঞান আর কোনো উপকার দিতে পারে না। আমরা বিজ্ঞান শাখার প্রতি সবাই যতটা আগ্রহী, বিজ্ঞানকে প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য ঠিক ততটাই পিছিয়ে আছি। তাহলে একজন শিক্ষার্থীর ১৭ (প্রাথমিক থেকে মাস্টার্স) বছরে অর্জিত মেধার কতটা অবমূল্যায়ন হচ্ছে তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। যখন কেউ এমন নিগ্রহের চিত্র প্রত্যক্ষ করে তখন তার মাথায় ১৭ বছরে অর্জিত বিদ্যা দিয়ে কিছু করবার চিন্তা আর থাকে না। সে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই গতানুগতিক ও নাম সর্বস্ব শিক্ষা নিতে থাকে, প্রস্তুত হতে থাকে উন্নত জীবিকার জন্য। তাইতো বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীকে ব্যাংকের চাকরির প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। পড়ালেখা করেছে বিবিএতে আবার এমবিএও করেছে। আর এখন একটা কোম্পানিতে আইটি সেক্টরে চাকরি করছে। তার কাছ থেকে বাণিজ্য শাখায় কোনো গবেষণাধর্মী জ্ঞান বা সৃজনশীল কিছু আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই হবে না। এমনই নানা অসঙ্গতি বিদ্যমান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও চাকরির বাজারে। বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটা দেশ পরিচালনার মূল কর্ণধার উৎপাদনের স্থান। সব শ্রেণির মানবসম্পদ উৎপাদনের স্থান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর মানবসম্পদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নেই। কথিত বিসিএস, ব্যাংক জব, শিক্ষকতা, আইন পেশার কর্মী উৎপাদনের কারখানায় রূপ নিয়েছে। এর বাইরে নতুন কিছু করা বা সৃজনশীল কোনো বিষয়ে ভাবনা আমাদের শিক্ষার্থীদের মাথায় উপস্থিত হতে পারছে না। আর উপস্থিত হলেও তা প্রয়োগের স্থান পাচ্ছে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একজন শিক্ষার্থী মাছ চাষের প্রচলিত অনুন্নত পদ্ধতি থেকে বের হয়ে নতুন একটা প্রজেক্ট স্থাপন করবে, যাতে তার নিজের কর্মসংস্থান হবে পাশাপাশি আরো ৫০ জন সাধারণ মানুষ বা অল্পশিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু প্রজেক্ট করার জন্য তার যে আনুষঙ্গিক জিনিস লাগবে সে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বা

ক্ষমতা তার নেই। এর জন্য তার সাহায্যের প্রয়োজন। আর সে ক্ষেত্রেই আমাদের মূল দুর্বলতা। আমি বলছি না যে, কোনো ধরনের ব্যবস্থা সরকারে পক্ষ থেকে নেই। আছে, কিন্তু তা অনেকটা অমাবশ্যার চাঁদ। ‘খাজনার চাইতে বাজনাই বেশি।’ মাছ চাষে যে নতুন ও উন্নত ব্যবস্থা সৃষ্টি হতো, যাতে হয়তো উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এই খাতটি আরো সমৃদ্ধি হতো। তা আর হলো না। আমরা নতুন কিছু থেকে খুব সহজেই বঞ্চিত হলাম।

তেমনি অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। একজন শিক্ষার্থী অর্থনীতি বিষয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনা করেছে, যেটা আমাদের প্রচলিত বাজার বা ব্যবসায়ী পদ্ধতির চাইতে ভালো কিছু দিতে পারবে। কিন্তু সে সেবা প্রদান ও গ্রহণের মতো মানসিকতা ও সুযোগ দুটোরই অভাব রয়েছে আমাদের। তেমনি মানবিক শাখার অবস্থাও একই রকম। যখন একটা বিষয়ে কেউ নতুন কিছু ভাবে এবং বাস্তবায়ন করতে চায়, কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার দরুন সেটা আর বাস্তবায়ন

হয় না। তখন সে আর সৃজনশীলতার

প্রতি আগ্রহবোধ ধরে রাখতে পারে না। তাই কোনো শিক্ষার্থী গতানুগতিক বিসিএস, ব্যাংক জব, আইন পেশা, শিক্ষকতা আর কোম্পানি জবের প্রস্তুতি ছাড়া সৃজনশীল কোনো কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চায় না। কারণ ব্যর্থতার গ্লানি বড় কঠিন।

তাই আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রস্তুত করতে হবে বাস্তবতার আলোকে। প্রয়োগমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেই চাকরির বাজারকে সাজাতে হবে। আবার শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাতে হবে উন্নয়নের জন্য, যা প্রয়োজন সে আলোকে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতার প্রতি উৎসাহের সঞ্চার করতে হবে। সে কাজে অনুপ্রেরণা, প্রণোদনাসহ যা প্রয়োজন তা সহজলভ্য করতে হবে। যেন একজন শিক্ষার্থীও তার সুপ্ত সৃজনশীলতা প্রকাশে বাধা প্রাপ্ত না হয়। মনে রাখতে হবে, সৃজনশীলতা ছাড়া কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist